জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হলেও প্রশাসনে, মন্ত্রণালয়ে শৃঙ্খলা ফেরেনি। তবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।
গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রশাসনের বিভিন্ন পদমর্যাদার কিছু সরকারি কর্মকর্তা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট, মানববন্ধন, কলম বিরতিসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পুনর্গঠন ও বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনে নামা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপও নিয়েছে সরকার।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মুখলেস উর রহমান ইউএনবিকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শৃঙ্খলাবহির্ভূত আচরণের বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর হচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এসব নিয়ন্ত্রণ করে দেশ পুনর্গঠনে কঠোর অবস্থানে থাকার নির্দেশনা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এখন থেকে কোনো সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী বিনা কারণে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মুখলেস উর রহমান আরও বলেন, প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’নীতি অনুসরণ করছে। সরকারের পক্ষ থেকে এখন আর আন্দোলন বা অকারণ কর্মবিরতি সহ্য করা হবে না। নির্বাচনের আগে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে এটি সরকারের সবচেয়ে কঠোরতম প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
আন্দোলন, অনিয়মে প্রশাসনে অস্থিরতা
গত এক বছরে এনবিআর, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, মাঠ প্রশাসন ও সচিবালয়ের বেশ কিছু স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাবি-দাওয়ার নামে ধর্মঘট, সমাবেশ, মানববন্ধন, কলম বিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে গেছেন। বিশেষ করে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন সরাসরি দেশের অর্থনীতি, রাজস্ব আদায় ও আমদানি-রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ব্যবসায়ীরা সরবরাহব্যবস্থা ও কাস্টমস প্রক্রিয়ায় জটিলতার কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমানকে অপসারণ দাবির মধ্যে জারি করা সবশেষ দুটি বদলি আদেশকে ‘প্রতিহিংসা ও নিপীড়নমূলক’দাবি করে তা ছিঁড়ে ফেলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সেই কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ায় মোট ১৪ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে সরকার। তাদের মধ্যে প্রথমে আটজন, পরে আরও ছয়জনকে বরখাস্ত করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সতর্কতা জারি
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ ব্যাপারে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিব এবং বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চিঠি পাঠিয়ে মন্ত্রণালয় বলেছে, সতর্ক না হলে প্রয়োজনে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চিঠিতে বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড ও আচরণ বিধি লঙ্ঘনের শামিল। অনেক ক্ষেত্রে তা জাতীয় নিরাপত্তা হানিকারক এবং সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী অসদাচরণের পর্যায়ভুক্ত অপরাধ।
চিঠিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা, ২০১৯’এর সুষ্ঠু ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য নির্দেশনা দিয়ে এ ধরনের প্রতিটি ব্যত্যয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯, সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা, ২০১৯ এবং সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা, ২০১৮ অনুসারে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আইন সংশোধনে নমনীয়তা : তদন্ত ছাড়া শাস্তি নয়
প্রশাসনিক অস্থিরতা ও সচিবালয়ে কর্মচারীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ‘সরকারি চাকরি (দ্বিতীয় সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’এর খসড়ায় কিছু নমনীয় সংশোধনী এনেছে। আগের নোটিশভিত্তিক শাস্তির বিধান বাতিল করে এখন থেকে কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হলে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন বাধ্যতামূলক। অভিযোগ গঠনের ৭ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ এবং জবাবের পর ৭ কর্মদিবসের মধ্যে সিদ্ধান্ত দিতে হবে।
আগের সংশোধনীতে অনেকটা নোটিশ দিয়েই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুযোগ ছিল। এ ছাড়া অপরাধের ধরনেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে সরকারি চাকরি (দ্বিতীয় সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এর আগে, গত ২৫ মে সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করে সরকার। তাতে চারটি বিষয়কে অপরাধের আওতাভুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হন, যা অনানুগত্যের শামিল বা যা অন্য যেকোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে, অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন, অন্য যেকোনো কর্মচারীকে তার কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তার কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন এবং যেকোনো সরকারি কর্মচারীকে তার কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন।
সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর দ্বিতীয় সংশোধিত অধ্যাদেশে যা আছে
সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর দ্বিতীয় সংশোধিত অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। গত ২৩ জুলাই আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরীর স্বাক্ষরে অধ্যাদেশটি জারি করা হয়।
নতুন সংশোধিত অধ্যাদেশ অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারী আন্দোলনে গেলে, অর্থাৎ নিজে নিয়ম লঙ্ঘন করে একজন সরকারি কর্মচারী আরেকজন সরকারি কর্মচারীর কাজে বাধা দিলে বা তাকে তার কাজ থেকে বিরত রাখলে, তাকে বাধ্যতামূলক অবসরসহ চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যাবে।
শৃঙ্খলা ফেরাতে পদোন্নতি ও পুনর্বিন্যাস
প্রশাসনের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিনের পদোন্নতি ও পদায়নের বৈষম্য দূর করতেও কাজ শুরু করেছে সরকার। গত ১৭ বছর ধরে রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ইতোমধ্যে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে আন্তঃবৈষম্য নিরসনে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। সচিবালয়ের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ক্যাডার-নন ক্যাডার মিলিয়ে নতুন নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বিধিমালা জারি করেছে। ইতোমধ্যে মাঠ প্রশাসন থেকে সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
তবে সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে তারা আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব আব্দুল আওয়াল মজুমদার ইউএনবিকে বলেন, “শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনে কখনোই নরম থাকা চলে না। যাদের হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও জনগণের ভাগ্য, তাদের ওপর জবাবদিহিমূলক কঠোর নজরদারি ছাড়া দুর্নীতি ও গাফিলতি রোধ অসম্ভব। ১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধানটি অনেক কঠোর, কেউ কেউ কালো আইন বললেও বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশাসন চালাতে গেলে এই আইনের প্রয়োজনীয়তা আছে। সরকার চাইলে চাকরিতে অনুপস্থিত কর্মচারীকে আট দিনের নোটিশে চাকরিচ্যুত করতে পারবে। এর জন্য পিএসসির মতামত বা তদন্তের প্রয়োজন হবে না।”
সাবেক এই সচিব বলেন, “সরকার যেসব কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে তা প্রশংসনীয় হলেও তা যেন কাগুজে নির্দেশনা হয়েই না থাকে। আগেও এমন অনেক আইন, নির্দেশনা, কমিটি হয়েছে; কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। সুতরাং চূড়ান্ত সফলতা নির্ভর করবে আইনের প্রকৃত অনুসরণ ও স্বচ্ছতামূলক প্রয়োগের ওপর।”
ঠিকানা/এসআর