Thikana News
০৮ অগাস্ট ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ০৮ অগাস্ট ২০২৫
গণঅভ্যুত্থানের এক বছর

প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তি কতটুকু?

প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তি কতটুকু?
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। শত শত মানুষের জীবন দান আর পঙ্গুত্ব বরণের মধ্য দিয়ে আসা ৫ আগস্টের বিজয় স্বাধীন দেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। ছাত্র-জনতার এই রক্তাক্ত বিজয় একটি নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন জাগিয়ে তোলে। বিজয়ের পরপরই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা পথে নেমে সেই স্বপ্নগুলো এঁকে দেয় দেয়ালে দেয়ালে। কিন্তু অভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকীতে অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে বিপ্লবের নায়ক ছাত্র-জনতার স্বপ্ন ও প্রত্যাশা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নজিরবিহীন নৃশংসতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার যে গণহত্যা চালিয়েছে এখনো এর বিচার দৃশ্যমান হয়নি। পরিবর্তনের যে প্রত্যাশা দিয়ে মানুষ রাজপথে নেমে অকাতরে জীবন দিয়েছে, পরিবর্তন এখনো অধরাই রয়ে গেছে। অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শক্তিগুলো নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল, তাও এখন ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। সামনে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা ও সেই সরকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে-এ নিয়েও শঙ্কা-সংশয় তৈরি হয়েছে মানুষের মাঝে। অভ্যুত্থানের মূল শক্তি শিক্ষার্থী-তরুণদের প্রত্যাশা পূরণে বড় কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি এই সময়ে। এ ছাড়া রাষ্ট্র সংস্কারে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাও এক বছরে প্রত্যাশিত পর্যায়ে আসেনি।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের বর্ষপূর্তির দিনে ৫ আগস্ট মঙ্গলবার রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোজার আগে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ায় দেশবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে। একই দিনে কাক্সিক্ষত জুলাই সনদ ঘোষণা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। এই ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে হতাশা ব্যক্ত করেছে জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচনের সুস্পষ্ট সময় ঘোষণা এবং জুলাই ঘোষণাপত্র নিঃসন্দেহে গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণের পথে বড় ধরনের অগ্রগতি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থান থেকে একটি নতুন গণতান্ত্রিক ধারা গঠনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু দলগত বিভাজন, দলীয় ও ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া এবং বাইরের হস্তক্ষেপ এই পরিবর্তনের পথে বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের স্বার্থে সবাইকে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার মনোভাবের মধ্য দিয়ে এ চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়া সম্ভব বলে মনে করেন তারা।
এদিকে রাজনীতিবিমুখ প্রজন্মের তরুণেরা জুলাই-আগস্টে গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে নতুন রাজনৈতিক ভাবনা প্রতিষ্ঠার সুযোগ এনেছে। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ছাড়াই তারা এক স্বৈরশাসনের ইতি টেনেছে। এতে তৈরি হয়েছে নতুন ধারার রাজনীতির স্বপ্ন। সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা ছিল, সরকার হবে জবাবদিহিমূলক, দুর্নীতিমুক্ত আর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে দৃঢ়প্রতিশ্রুত। কিন্তু মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সেই আশায় নেমেছে ধূসর ছায়া। অন্তর্বর্তী সরকার বা নতুন দলগুলো এখনো পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারেনি, তারা আদৌ ভিন্ন কিছু। একই সঙ্গে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোও পুরোনো বৃত্ত ভাঙতে পারছে না। রাজনীতিকদের এ দ্বন্দ্ব দেশকে সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
অন্যদিকে শেখ হাসিনার পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নামেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। কয়েক মাস ধরে টানা এই আন্দোলন চলে। এই সময়ে চরম জনভোগান্তির সৃষ্টি হয়। বঞ্চিতদের পাশাপাশি আগের সরকারের আমলে বহু সুবিধাভোগী নিজেদের সুবিধা বাগিয়ে নেন কৌশলে। সবচেয়ে বেশি সুবিধা নেন আমলা ও পুলিশ।
এ ছাড়া দেশজুড়ে মব ভায়োলেন্সের ঘটনায় কয়েক শ মানুষ নিহত এবং বহু আহত হন। অনেকের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ ও চাঁদাবাজির ঘটনাও ঘটে। চরম অবনতি ঘটে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। ধীরে ধীরে সেই পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে।
গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বেশ কিছু অঘটন ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে সচিবালয়ে আনসারদের বিক্ষোভ, রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় ডাকাতির চেষ্টা এবং গণপ্রতিরোধ, বিনা পরীক্ষায় পাসের জন্য একশ্রেণির ছাত্রের বিক্ষোভ, ঢাকার সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আন্দোলন-বিক্ষোভ, সচিবালয়ে আমলাদের বিক্ষোভ ও ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম এবং সচিবালয়ে রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডের মাধ্যমে বহু মূল্যবান নথিপত্র, কম্পিউটার ও আসবাবপত্র ভস্মীভূত করা এসবসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আইনশৃঙ্খলাজনিত বহুবিধ ঘটনায় গণতন্ত্র অর্জনের সংগ্রামে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছিল, তা হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনমনে হতাশার মেঘ গাঢ় হতে শুরু করেছে।
এসব ঘটনায় চব্বিশের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে জবাবদিহিমূলক, দুর্নীতিমুক্ত, গণমুখী রাষ্ট্রের বদলে এক বছর পার না হতেই মানুষের আশার দেয়ালে স্পষ্ট চিড় ধরেছে। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আস্থাহীনতা তো ছিলই, এখন নতুন দল এনসিপির মধ্যেও পুরোনো রাজনীতির উপসর্গ দেখা দেওয়ায় বিশ্লেষকেরা হতাশা প্রকাশ করছেন। তারা এটাকে ক্ষমতার লড়াই বলেই মনে করছেন।
বাংলাদেশ এখন এমন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে নেতৃত্বের সাহস, নৈতিকতা ও জনগণের সঙ্গে সংযোগ ছাড়া ভবিষ্যৎ নির্মাণ অসম্ভব। জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ না বাড়ালে, শুদ্ধ রাজনীতির পরিবর্তে পুরোনো রাজনৈতিক পদ্ধতিই ফিরে আসবে। আর তখন এই ‘নতুন’ রাজনীতির গল্প হবে শুধু ব্যানারে লেখা স্লোগান, বাস্তবে পুরোনো রাজনীতিরই পুনরাবৃত্তি। বাংলাদেশের মানুষ চায় বাস্তবতা, একটি নৈতিক, জবাবদিহিমূলক ও জনগণের রাজনীতি।

কমেন্ট বক্স