গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বতী সরকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণে হতাশ করেছে বলে মনে করে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক)। আসক বলছে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সংখ্যালঘুদের নির্যাতন, ‘মব সন্ত্রাস’, নারীর প্রতি সহিংসতার মতো ঘটনা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) আসকের সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয়, ন্যায়, মানবিক মর্যাদা ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল এই আন্দোলন। দমন-পীড়ন, বৈষম্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছাত্র-জনতা শাসকগোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ করে রাস্তায় নেমে আসে এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। এই আন্দোলন কেবল একটি রাজনৈতিক পালাবদল নয়, বরং এটি ছিল একটি নতুন যুগের সূচনা; যেখানে মানুষের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রের জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রত্যয় নিয়ে গড়ে উঠেছিল একটি বিস্মৃত গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণ।
আসক বলে, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য, আন্দোলনের পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণে হতাশ করেছে। এখনো নির্বিচারে গ্রেপ্তার চলছে। হেফাজতে মৃত্যু ও বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে, যা আগের সরকারের দমনমূলক আচরণের পুনরাবৃত্তির মতোই। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির কারণে নাগরিকের নিরাপত্তা-বিষয়ক উৎকণ্ঠা চলমান রয়েছে।’
বিবৃতিতে বলা হয়, সারা দেশে উচ্ছৃঙ্খল জনতার মাধ্যমে সংঘটিত ‘মব সন্ত্রাস’-এর ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনৈতিক প্ররোচনায় পরিচালিত কিংবা সামাজিক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে সংঘটিত এসব সহিংস কর্মকাণ্ডে বহু সংখ্যক মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানসমূহ এসব ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে, যা মানবাধিকারের জন্য এক গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।’
আসক বলে, ‘বর্তমান পরিস্থিতির আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ক্রমাগত দুর্বল এবং সুরক্ষাহীন অবস্থা। জনগণের প্রত্যাশা ছিল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নিপীড়ন এবং হুমকির ঘটনা আরও বেড়েছে। এমনকি ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালানো হয়েছে, যার মধ্যে লুটপাট এবং জীবননাশের হুমকিও রয়েছে। এসব ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো বিচার বা শাস্তি না হওয়ায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা আরও গভীর হয়েছে।’
বিবৃতিতে বলা হয়, গণআন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা নারীর জন্য পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে উঠেছে। নারীরা বর্তমানে এক বিস্মৃত নিরাপত্তাহীনতার আবহে জীবনযাপন করছেন। বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে নারীদের মারধর, অপমান এবং শারীরিক নিপীড়নের ঘটনা বেড়েছে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি এবং পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতা এখন প্রায় নিয়মিত সংবাদে উঠে আসছে। নারীদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়ানো, তাদের পোশাক বা আচরণ নিয়ে নৈতিকতা নির্ধারণের চেষ্টা তথা ‘মোরাল পুলিশিং’এর নামে যা দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে।
এতে বলা হয়, ‘নারীদের এই নিপীড়ন কেবল ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি কাঠামোগত সহিংসতার রূপ নিয়েছে, যেখানে নারীদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সংবাদমাধ্যম নানা রকম হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। শত শত সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল, কৌশলে চাকরিচ্যুতি, মিথ্যা অভিযোগ ও মামলা, গ্রেপ্তার, সংবাদপত্র অফিসে হামলা এবং মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতার চর্চা কতটুকু বিদ্যমান-সেই প্রশ্নটিও বছরজুড়ে অব্যাহত ছিল।’
আসক বলে, ‘শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অনেক শিক্ষার্থীকে অন্যায্যভাবে প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে, সনদ বাতিল করা হচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হুমকির মুখে পড়ছে।’
তবে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যেও আশাবাদ ব্যক্ত করে আসক বলেছে, বাংলাদেশ বলপূর্বক গুম থেকে রক্ষার আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে এবং পূর্ববর্তী শাসকগোষ্ঠীর কর্তৃত্বে সংঘটিত গুমের অপরাধ তদন্তের জন্য একটি ‘গুম কমিশন’ গঠন করেছে। এটি বাংলাদেশের জন্য দায়বদ্ধতার পথে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হচ্ছে। তবে একই সঙ্গে ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন’ পুনর্গঠন না করাটা মানবাধিকার রক্ষায় সরকারের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে মনে করে আসক।
বিবৃতিতে আসক আইনের শাসন, আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে জোরালো দাবি জানায়। পাশাপাশি বাছবিচারহীন গ্রেপ্তার, মব সন্ত্রাস ও সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ, নারীর প্রতি সহিংসতায় জিরো টলারেন্স বাস্তবায়ন, মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ, সভা-সমাবেশ ও সংগঠন করার সাংবিধানিক অধিকার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের দাবি জানায় আসক।
আসক বলে, সংকট নিরসনে রাষ্ট্রকে এখনই কার্যকর, দায়িত্বশীল ও মানবাধিকার-বান্ধব ভূমিকা রাখতে হবে, যাতে জনগণের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত পরিবর্তনের স্বপ্ন ব্যর্থ না হয়। বিবৃতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি ঘোষণা করায় সাধুবাদ জানিয়েছে আসক।
ঠিকানা/এনআই