মিথ্যা কতটা প্রবল হতে পারে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিমে এবং এখনকার ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতিত অংশের কর্মকাণ্ডে। তার আগে বলে নিই সুহৃদ জুলকারনাইন সায়ের সামির আল-জাজিরার প্রতিবেদন ‘জুলাইয়ের ৩৬ দিন’-এর টাইমিংয়ের ব্যাপারটি। এটি এমন একটি সময়ে প্রকাশিত হয়েছে, যখন ভারতের দিল্লিতে পলাতক ফ্যাসিস্ট চক্র ‘বাংলাদেশের গোপালগঞ্জে গণহত্যা চলছে’ এমন বিষয়ে একটি প্রেস কনফারেন্সের আহ্বান করেছিল। একই সঙ্গে বাংলাদেশের একটি দৈনিক আয়োজন করেছিল একটি গোলটেবিল বৈঠকের। যে বৈঠকে অনেকেই আওয়াজ তোলার চেষ্টা করছিলেন, বাংলাদেশের বেআইনি আটক, গ্রেপ্তার ও নির্যাতন নিয়ে কেউ ভয়ে কথা বলছে না, এমন প্রসঙ্গে।
দিল্লির আহূত প্রেস কনফারেন্স এবং বাংলাদেশের গোলটেবিল বৈঠকের কোনো যোগসূত্র আছে কি না জানি না, তবে আল-জাজিরা দুটো চুলোর আগুনেই পানি ঢেলে দিয়েছে। আল-জাজিরা পরিষ্কার প্রমাণ করে দিয়েছে, ৩৬ দিনের নৃশংসতার বিষয়টি। এর আগে বিবিসিও করেছিল একটি কল রেকর্ডিংয়ের ফরেনসিক সত্যতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। কিন্তু আল-জাজিরার কাজটি ছিল আরও বিস্তৃত। জুলকারনাইন এর জন্য অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স ম্যান’ এর মাধ্যমে সূচনা করেছিলেন বাংলাদেশ নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্টিংয়ের এক নয়া দিগন্তের। সেই রিপোর্টে অনেকেরই পরনের কাপড় খুলে গিয়েছিল। আর ‘জুলাইয়ের ৩৬ দিন’ এর টাইমিংটাও অনেকের মুখোশ খুলে দিয়েছে। চিনতে সহায়তা করছে ‘মুখে শেখ ফরিদ আর বগলে ইট’ রাখা মানুষদের।
দিল্লির সাউথ ব্লক ইদানীং বাংলাদেশ বিষয়ে মানবতার ফেরিওয়ালা সাজতে চাইছে। তারা গোপালগঞ্জ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়, গোপালগঞ্জের অনেক মানুষের নাড়িপোঁতা ভারতে। ৪৭ এর দেশভাগের পর তারা ভারত থেকে গোপালগঞ্জের ভূখণ্ডে এসেছে। যাকগে, নাড়িপোঁতার কথাটি থাক, আসি ভারতের মানবতা বিষয়ে। প্রশ্ন করে দেখুন তো, শাপলা গণহত্যার ব্যাপারে ভারতের কনসার্ন কী ছিল? তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল কি? মোদির বাংলাদেশ আগমন উপলক্ষে বিরোধীদের ওপর যে খুনের উৎসব করেছিল ফ্যাসিস্ট রেজিমের খুনে বরকন্দাজরা, তখন ভারতের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? ছিল কিছু? সেই হত্যার তদন্ত ও বিচার কি তারা চেয়েছিল? চব্বিশের জুলাইয়ে যখন তরুণ তাজা প্রাণগুলো বুলেটের আঘাতে নিভে যাচ্ছিল, তখন ভারতের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? তারা কি এসবের তদন্ত বা বিচার চেয়েছিল, চেয়েছে? চায়নি। তাহলে গোপালগঞ্জে কী ঘটল, তা নিয়ে তাদের মাইগ্রেনের ব্যথা উঠল কেন?
গোপালগঞ্জে একটি রাজনৈতিক দল সভা-সমাবেশ করবে। সে সভায় তাদের রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তাহলে সেই সমাবেশকে বন্ধ করতে হবে কেন? কেন সেই রাজনৈতিক দলের ওপর আক্রমণ চালাতে হবে। এসব প্রশ্ন কি ভারতের থিঙ্কট্যাঙ্কারদের মাথায় আসেনি? এসেছে অবশ্যই, কিন্তু তাদের চিন্তা একপাক্ষিক। তাদের পক্ষপাতিত্ব বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত ফ্যাসিস্ট রেজিমের প্রতি। যার ফলে তারা বাংলাদেশের জনমানুষের বিরোধিতা সত্ত্বেও সেই ফ্যাসিস্ট রেজিমকে আশ্রয় দিয়েছে এবং প্রশ্রয় দিচ্ছে তাদের সকল উসকানিমূলক কার্যকলাপের। একটা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিতাড়িত একটি রেজিমের কিছু লোককে আশ্রয় দেওয়াটাই ছিল চরম উসকানি। আর এখন তো সব ‘খুল্লাম খুল্লা’।
গোপালগঞ্জ নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র তথা আসকের একটি প্রতিবেদনকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের বিশেষ একটি দৈনিক। সেখানে বলা হয়েছে, গোপালগঞ্জের ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্রুত মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করতে হয়েছে। ২১ জুলাই পর্যন্ত ১৮ জন শিশুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আটকের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করা হচ্ছে ইত্যাদি। এতে যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়, তবে একটি দলের শত শত কর্মীকে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা, তাদের মৌলিক রাজনৈতিক অধিকার সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়া, দলটির অসংখ্য কর্মীকে আহত করা, দলটির মূল নেতৃবৃন্দকে অবরুদ্ধ করে তাদের প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেওয়া-এসব তাহলে কী? যারা ‘মব’ সৃষ্টি করল, মব ভায়োলেন্স ঠেকাতে যেখানে বাহিনীগুলো তৎপর হলো, সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় নিতে হলো সেই বাহিনীকেই। সভা-সমাবেশের অধিকারের কথা উল্লেখ করেও আসক বলেছে, সেখানে নাকি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কথা বলাতেই লোকজন ক্ষুব্ধ হয়েছে। আজব এই আসকের আলাপ। যে রাজনৈতিক দলটি গড়ে উঠেছে মুজিববাদের বিরোধিতা করে, যে দলটির নীতিই আওয়ামী তথা ফ্যাসিজমের বিরোধিতা, সেই দলটি কি তাদের কথা বলতে পারবে না? বিস্ময় হয় আসকের এই পর্যবেক্ষণ দেখে। সরি টু সে, এই আলাপ মূর্খের আলাপ। এই ন্যারেটিভ ফ্যাসিজমকে প্রতিষ্ঠিত করার ন্যারেটিভ। যদি ফ্যাসিস্ট রেজিমে আসক এই আলাপ করত, তাহলে যারা পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা মুক্ত ঘুরতে পারতেন না।
একটা অঞ্চল, যেখানে একটা মিলিট্যান্ট শক্তি অবস্থান নিয়ে আছে, সেখানের সেই মিলিট্যান্ট শক্তির বিরুদ্ধে কথা না বলে আইন ও সালিশ কেন্দ্র কথা বলছে নিরস্ত্র কিছু মানুষের বিপক্ষে, আজব। এদের প্রতিষ্ঠানের নাম শুরু হয়েছে আবার আইন দিয়ে। জানি, কেউ কেউ বলবেন, আসক তো ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিরুদ্ধেও কথা বলেছে। এর সরাসরি জবাব না দিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের নেতা হাদির বক্তব্যকে উদ্ধৃত করি। তিনি তার এক বক্তব্যে বলেছেন, আর আগে কিছু ঘটলেই বলা হতো রাষ্ট্র এটা করছে, ওটা করছে। সব দোষ হতো রাষ্ট্রের। তারা ফ্যাসিস্টদের নাম মুখে আনত না, এখন তারা সরাসরি ইউনূস সরকারকে দোষ দেয়, ইন্টেরিমকে দোষ দেয়। আসক সেই ফ্যাসিস্ট রেজিমেও সেই কাজই করেছে, রাষ্ট্রকে দোষ দিয়েছে, রেজিমকে নয়। এখন তারাও ভারতের মতো মানবাধিকারের চরম ফেরিওয়ালা সেজেছে। অথচ এদের গংদের কেউ কেউ আবার যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার-বিষয়ক কার্যালয় খোলার বিরোধিতা করছে। এদের গংরাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ঠেকানোর নামে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদকে স্থায়ী করার চেষ্টা করেছিল এবং এখন পর্যন্ত সেই চেষ্টা থেমে নেই।