শিক্ষকশ্রেণির বাইরে আর যারা অন্য পেশায় রয়েছেন, তাদের মধ্যে প্রথমে আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের কথা উল্লেখ করতে হয়। তিনি ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি’র (বেলা) প্রধান নির্বাহী রূপে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করে আসছেন। ঢাকায় তার জন্ম; পৈতৃক ভূমি সিলেটে। পিতা সৈয়দ মহিবুল হাসান সিলেটের জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন। সৈয়দ রিজওয়ানা হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন এবং একাধিক সভা-সভাবেশে উপস্থিত থেকে ও ভাষণ দিয়ে তাদের উৎসাহিত করেন। সাংগঠনিকভাবে মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ ও বিবৃতিতে স্বাক্ষরদান করেও তিনি আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন জানান। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগ ও যুবলীগ পরিকল্পিতভাবে হামলা, লাঠিসোটা ও অস্ত্র নিয়ে মারপিট করে অনেককে আহত করে। পরের দিন ১১৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক এর প্রতিবাদ জানিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান স্বাক্ষর করেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গণহত্যা, গণগ্রেপ্তার ও গণমামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ও প্রতিকারের দাবি জানিয়ে ‘বিক্ষুব্ধ ৭৪ নাগরিক’ যে বিবৃতি গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন, সেখানেও তিনিও স্বাক্ষর করেন।
৩০ জুলাই দেশের বিশিষ্ট নাগরিকগণ ‘ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি’তে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’ ব্যানারে ‘হত্যা, অবৈধ আটক ও নির্যাতনের বিচার চাই’ শীর্ষক এক সম্মেলনের আয়োজন করেন। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তার ভাষ্য : ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে ছাত্র-জনতাকে হত্যা, জুলুম ও নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ... এমন নির্মম হত্যাযজ্ঞের ও বলপ্রয়োগের নিন্দা বা প্রতিবাদের উপযুক্ত ভাষা আমদের জানা নেই। এই বিপুল প্রাণহানির দায় প্রধানত সরকারের। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর যে মাত্রায় বলপ্রয়োগ ও সন্ত্রাসী কায়দায় আক্রমণ করা হয়েছে, তা দেশের জনগণ ও বিশ্ববিবেককে স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত করেছে।’ (প্রথম আলো, ৩১-৭-২৪)।
‘সহসা সংকট উত্তরণের উপায় নেই’ শিরোনামে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনে’র (১-৮-২৪) প্রতিবেদক জিন্নাতুন নূরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সংকট যে আছে তা যদি সরকার স্বীকার না করে এবং এর রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিকার না খোঁজে, তাহলে কেমন করে সংকটের সমাধান হবে? দেশে চলমান সংকট সমাধানের বা সংকট থেকে উত্তরণের সুযোগ সরকার হারিয়েছে। আমার ধারণা, সরকার কোটা বিষয়টি নিয়ে খেলছে। একবার কোটা বাতিল হয়ে যাওয়ার পর আবার যখন কোটাপ্রথা ফিরে আসে, তখন আদালতে সরকার কতটা বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে, এটা খতিয়ে দেখতে হবে। শেষ পর্যন্ত অনেক প্রাণের বিনিময়ে আমরা কোটা সংস্কার বিষয়ে ধারণা বা নির্দেশনা পেলাম আদালত থেকে। এরই মধ্যে অনেক প্রাণ ঝরে গেছে, এ প্রাণগুলো সব তরুণ ও যুবক। সরকার এখন শোক পালন করছে। ... রংপুরের যে ছেলেটি মারা গেল, আমরা চোখের সামনে দেখলাম, সে গুলিতে মারা গেল। কিন্তু সরকার এফআইআরে লিখে রাখল-ইটপাটকেলে ছেলেটির মৃত্যু হয়েছে। এগুলো মানুষের ক্ষোভকে, মানুষের সন্দেহকে অনেক বেশি বাড়িয়ে দিচ্ছে। আসলে অনেক বছর ধরেই মানুষের অনেক কিছু নিয়ে ক্ষোভ আছে।’ ১ আগস্ট তিনি ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজে’র মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে অন্যান্য বক্তার সঙ্গে নিজ অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, ‘গায়েবিভাবে আমাদের বাসা থেকে তুলে আনবেন, সেই আইন ও ক্ষমতা আপনাদের দেওয়া হয়নি। ... আপনারা বাংলাদেশ পুলিশ হবেন, আওয়ামী লীগ পুলিশ, বিএনপি পুলিশ, জাতীয় পার্টি পুলিশ হবেন না। এটাই আমরা চাই।’
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তার সাহসী ভূমিকার জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন। তিনি বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টারূপে গুরুদায়িত্ব পালন করছেন।
২৮ জুলাই গ্রেপ্তার-নির্যাতনের প্রতিবাদে ‘নারীপক্ষ’ (১৯৮৩) নামের একটি সংগঠন অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। এর সভানেত্রী গীতা দাস ও আন্দোলন সম্পাদক সাফিয়া আজীম। প্রথম আলো পত্রিকায় (২৯-৭-২৪) নিজস্ব প্রতিবেদক বলেন, ‘হয়রানিমূলক গ্রেপ্তার-নির্যাতন বন্ধ করো’, ‘গুম, খুন, হত্যা আর না’, ‘সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের বাক্স্বাধীনতা ও ভাবপ্রকাশের অধিকার রয়েছে’-এমন সব স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বেসরকারি সংস্থা নারীপক্ষ গতকাল রোববার রাজধানীর সাতমসজিদ রোডে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে প্ল্যাকার্ডের লেখা তুলে ধরা হয় কর্মসূচিতে। কেউ কেন বক্তব্য দেননি। অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে নারীপক্ষের এক বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘সংবিধান বর্ণিত মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখার’ দাবিতে এই কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। কর্মসূচিতে নারীপক্ষের প্রায় ৩০ জন সদস্য ও কর্মী উপস্থিত ছিলেন। অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেন নারীপক্ষের সভানেত্রী গীতি দাস, প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী শিরীন হক, সাবেক সভানেত্রী মাহীন সুলতান, সদস্য কামরুন্নাহার, আন্দোলন সম্পাদক সাফিয়া আজমসহ অনেকে।’
‘মায়ের ডাক’ (২০১৬) মায়েদের একটি প্ল্যাটফর্ম। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম-খুনের শিকার হয়েছে, এমন সব পরিবারের মায়েরা/সদস্যরা একত্র হয়ে এটি (২০১৩) গড়ে তোলেন, যার মাধ্যমে নিহত ও নিখোঁজ সন্তানদের ভাগ্যের পরিণতি জানার জন্য কথা বলতে পারেন। প্ল্যাটফর্মটিতে মূলত জাতীয়তাবাদী দলের ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন, কারণ রাজনৈতিক দল হিসেবে তারাই সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। আর্জেন্টিনার ‘মাদার অব দ্য মায়ো’ অনুরূপ একটি সংগঠন ছিল। সংগত কারণেই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রতি তারা সংহতি প্রকাশ করেন এবং আন্দোলনের কর্মসূচি পালনে এগিয়ে আসেন।
‘ক্ষুব্ধ নারী সমাজ’ বিভিন্ন পেশা ও শ্রমজীবী নারীদের নিয়ে আন্দোলন চলাকালে গঠিত একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম, যার মাধ্যমে তারা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন এবং স্বৈরাচার সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকেই জন্মÑএর নামকরণের মধ্যে তারই ইঙ্গিত রয়েছে। সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন নারীনেত্রী ফরিদা আখতার (বর্তমানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা)। ফরিদা আখতারের (জ. ১৯৫৬) পিতৃভূমি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়। তিনি বিশিষ্ট সমাজচিন্তক ফরহাদ মজহারের সহধর্মিণী। একজন লেখক ও কলামিস্ট হিসেবেও ফরিদা আখতারের পরিচিতি রয়েছে। তিনি ‘ক্ষুব্ধ নারী সমাজে’র জন্ম ও আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে মূলধারার কর্মসূচি পালনের বিবরণ দিয়েছেন ‘বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’কে (বাসস) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের মাঝামাঝি এমন হয়েছিল যে, আমরা একে অপরকে ফোন করে কথা বলতাম, সারা রাত অস্থিরতায় ঘুমাতে পারতাম না। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। চারদিকে ছাত্রছাত্রীসহ সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, গুলি ছাত্রলীগের হামলা। এমন একটা নিষ্ঠুরতার দৃশ্য দেখছিলাম, কিন্তু কিছু করাও যাচ্ছিল না। ... আমরা শেষে কয়েকজন নারী মিলে ‘ক্ষুব্ধ নারী সমাজ’ নাম দিয়ে একটা প্ল্যাটফর্মের মতো করি। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, নারী আন্দোলনকর্মী, শ্রমিকনেত্রীরা এসে জড়ো হতে শুরু করলেন। একপর্যায়ে আমরা ভাবলাম, একটা প্রেস কনফারেন্স করব। ক্ষুব্ধ নারী সমাজের পক্ষ থেকে রিপোর্টার্স ইউনিটিতে একটা প্রেস কনফারেন্স করি। তখন আমরা শুধু একটা কথাই বলেছি, চারদিকে হত্যাকাণ্ড হচ্ছে, এটা নির্মম নিপীড়ন। এটা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর নিপীড়ন দেখে আমরা জুলাইয়ের শেষের দিকে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলাম। নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমাদেরও মাঠে নামতে হবে। আমাদের ওপর ঝড়-ঝাপ্টা যা আসুক, সেটা মাথায় নিয়ে রাস্তায় অবস্থান নেব।’ এরপর তিনি বলেন, শাহবাগ, শহীদ মিনার প্রভৃতি স্থানে মিছিল করে আন্দোলনরত জনতাকে উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়েছেন। যেদিন পুলিশের বাধার মুখে পড়ে যেতে পারেননি, সেদিন নিকটস্থ মোহাম্মদপুরের সাত মসজিদ রোডে সমাবেশ করে সেøাগান দিয়ে ও বক্তৃতা করে আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন।
‘ঢাকার রিপোর্টার্স ইউনিটি’তে ক্ষুব্ধ নারী সমাজ ওই প্রেস কনফারেন্সটি করে ৩১ জুলাই। ‘সকল লাশের হিসাব করো, গ্রেপ্তার-নির্যাতন বন্ধ করো’ শীর্ষক ওই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ঋতু সাত্তার। তিনি একজন অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী। চিত্রনির্মাতা রূপেও তার পরিচিতি আছে। ঋতু সাত্তার বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে ১৭ জুলাই থেকে টানা কয়েকশ বিজিবি যেভাবে নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছে, তা নজিরবিহীন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করেছেন। ...ঢাকাসহ সারা দেশে অতিরিক্ত পুলিশ, বিজিবি ও সেনা মোতায়েন করে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। আন্দোলনকারী আহত শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানেও তাদের ওপর হামলা হয়েছে কিংবা ধরে নিয়ে গেছে। কারফিউ জারি করে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়ে জনজীবনে আতঙ্ক সৃষ্ট করা হচ্ছে। আন্দোলনকারীরা কোনো অপরাধমূলক কাজ করেননি, অথচ তাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এলাকায় এলাকায় ব্লক রেইড দিয়ে গণহারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডের নামে চরম নির্যাতন করা হচ্ছে।’ (দৈনিক গণজাগরণ, ১৭-৭-২৫)।
লিখিত বক্তব্যে ৬ দফা দাবিও জানানো হয় : ১. বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফা দাবি মেনে নিতে হবে; ২. সব আটককৃত শিক্ষার্থীকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে; ৩. হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে হবে; ৪. কারফিউ প্রত্যাহার করে বিজিবি ও সেনাবাহিনী তুলে নিতে হবে; ৫. সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দিতে হবে; ৬. সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে হুমকি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন রেহনুমা আহমেদ, তসলিমা আখতার, মাহা মির্জা, বহ্নিশিখা জামালী, শিরিন হক, শারমিন মোর্শেদ জান্নাতুল মাওয়া, বীথি ঘোষ, কৃষ্ণকলি প্রমুখ। অনুমিত হয়, এরাই ক্ষুব্ধ নারী সমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন নারীনেত্রী ফরিদা আখতার। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন নারী সংগঠনের প্রতিনিধি, লেখক, শিল্পী, অভিনেত্রীসহ সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী নারীরা উপস্থিত ছিলেন। (প্রথম আলো, ১-৮-২)।
‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’ (১৯৭০) একটি পুরোনো নারী সংগঠন। কবি সুফিয়া কামাল এর প্রথম সভাপতি, পরে মালেকা বেগম সভাপতি হন; বর্তমানে ফওজিয়া মোসলেম সভাপতি ও মালেকা বানু সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট হলেও হত্যা, গণগ্রেপ্তার, গুম-খুনের ঘটনা এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে যে, মহিলা পরিষদ নীরব থাকতে পারেনি। ৩০ জুলাই নারীপক্ষের পক্ষ থেকে উভয়ের স্বাক্ষরিত ও এক বিবৃতির কথা জানা যায়। বিবৃতিতে তারা চলমান আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপক হয়রানি বন্ধ করে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনার দাবি করেন এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির যাতে আর অবনতি না ঘটে, সে জন্য সরকার ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের আহ্বান জানান। (প্রথম আলো, ৩১-৭-২৪)।
‘ব্রতী’ (২০০১) নামক একটি এনজিও সংস্থার কথা বলতে হয়। এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হলেন শারমীন মুরশিদ (বর্তমানে সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা)। একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবেও তার সুনাম আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের স্বনামখ্যাত অধ্যাপক খান সরওয়ার মুর্শিদ ও নূরজাহান মুর্শিদ ছিলেন তার পিতামাতা। তার পুরো নাম শারমীন সোনিয়া মুরশিদ। ইংরেজিতে শারমীন এস মুরশিদ লিখে থাকেন। আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনের সমর্থনে বিভিন্ন নারী সংগঠনের কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন, বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন। তিনি ‘দ্য ডেইলি স্টার’ পত্রিকায় (২৫-৭-২৪) ‘The government should take responsibility for its mistakes’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এতে তিনি আন্দোলন দমনে সরকারের গৃহীত নিবর্তনমূলক নিষ্ঠুর পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন এবং ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরেন। তিনি ১৮ ও ১৯ তারিখের রামপুরার ও মহাখালীর সংঘর্ষের চাক্ষুষ বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘It was Thursday, July 18, Notun Bazar, Badda, Rampura, Banasree, and adjacent areas were some of the hotspots of violence. I leave nearby. I go out every day like an observer to see if our children need help. I found them battling armed police and cadres with stone and sticks. On Thursday, they were thirsty, and tired, and asked for water and saline. „ Till date (Jule 24) reports from various sources say that over 2,500 people have been arrested, 146 have been killed, and thousands injured. Observers say that the number of casualties may rise even further.
A student protest over a legitimate demand has been blown out of all propotions. A piecefull gathering, a demands for right to equal opportunity, a demand for reforms in a qoata policy has been ruthlessly and brutally repressed – turning a small issue-specific student movement into a bizarre national crisis. The utterly lack of empathy and sensitivity of the needs of our children is shocking. This catastrophy could have been avoided at many levels.
The government could have solved the qoata issue without involing the court. The court clearly stated that this could have been resolved through the executive powers of the government. The government wasted time while the violence continued. „ The government should take responsibility for its mistakes.’
লেখিকা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন-সরকার কী করেছে এবং তার কী করা উচিত ছিল। কিন্তু ‘চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি।’ চোর একদিন না একদিন ধরা পড়ে এবং ধরাশায়ী হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের অনুরূপ পরিণতি হয়েছে।
‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’ হলো মা-বাবার মিলিত একটি প্ল্যাটফর্ম; আন্দোলন চলাকালে এর জন্ম। রাখাল রাহা ছিলেন এর উদ্যোক্তা, তার সঙ্গে যোগ দেন অন্যতম সংগঠক আসফিয়া আজম। তিনি পেশায় ছিলেন একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। আসফিয়া আজমের লেখা এবং ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় (৪-১১-২৪) প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে সংগঠনের উদ্ভব ও কর্মধারার যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা এখানে উল্লেখ করা হলো। তিনি বলেন, ‘চাকরি, সংসার, সামাজিকতা আর দৈনন্দিনকতার চাপে আমার জেরবার অবস্থা। জুলাইয়ের প্রথম আট-দশ দিন তাই কোনো কিছু আমার তেমন গোচরে আসেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দু-একটা লিংক আর ফোনের আলাপচারিতার মধ্যে একটু-আধটু খবর পাই আন্দোলনের। ছাত্ররা নাকি আবার কোটাব্যবস্থার বিরোধিতা শুরু করেছে! ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ হচ্ছ, মিছিল করছে, পথরোধ করছে ছেলেমেয়েরা। খুব একটা মনোযোগ দিইনি এসবের দিকে। এর মধ্যে হঠাৎই একদিন, খুব সম্ভবত ১১ বা ১৪ তারিখে একটা অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল। দুপুরের দিকে অফিসের কাজে বেরিয়েছি। রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের কাছাকাছি আসতেই কয়েকজন ছাত্রছাত্রী আমার গাড়ি ঘিরে ধরে ভদ্রভাবেই বলল, গাড়ি নিয়ে আর এগোনো যাবে না, ওরা রাস্তা ব্লক করেছে। ... মিষ্টি দেখতে একটি মেয়ে আমাকে বলল, ‘আন্টি, আপনারা আমাদেরকে সাপোর্ট না করলে কীভাবে সফল হব?’ এ কথার পর তো আর কোনো কথা চলে না। আমি ল্যাপটপের ব্যাগ, জরুরি ফাইলপত্র গাড়িতে রেখে নেমে এলাম রাস্তায়। হাঁটতে শুরু করলাম মিছিলের পাশে পাশে। ছাত্রছাত্রীরা হাত ধরাধরি করে, স্লোগান দিতে দিতে এগোচ্ছে।... বয়সটা কেমন হুট করে কমে গেল! রক্তে বেশ একটা দোলা লাগল। মিরপুর রোডটাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলে মনে হলো। আমিও ওদের সঙ্গে স্লোগান দিতে শুরু করলাম ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা।’
পরদিন থেকে পত্রিকা, যোগাযোগমাধ্যমে আন্দোলনের খবরাখবর, ছাত্রছাত্রীদের ওপর নির্যাতনের খবর পড়তে শুরু করলাম। ১৬ তারিখে একটা সময়ে আবু সাঈদের ভিডিওটা এল, অবশ করে দিল আমাকে। ছেলেটা ঠিক আমার মেয়ের বয়সী। ঘুমাতে পারলাম না সারা রাত। ... ঠিক এর একদিন পর সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে ফারহান ফাইয়াজের ছবি, খবর। রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের ছাত্র। ঠিক আমার ছেলের বয়সী। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল আমার। সিদ্ধান্ত নিলাম আর ঘরে থাকা যাবে না। একটা কিছু করতেই হবে। আমার সন্তানসম বাচ্চাদের নির্বিচারে মেরে ফেলা হবে, আর মা হয়ে আমি ঘরে বসে থাকব? এটা হতে পারে? চারদিকে যোগাযোগ করতে শুরু করলাম। বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশী, পরিচিত সুহৃদেরা সবাই একমত, কিছু একটা করতে হবে। কবি মাহমুদ মোরশেদ খবর দিলেন, রাখাল রাহা নামে একজন ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’ ব্যানারে কিছু একটা করার চেষ্টা করছেন। ... নম্বর জোগাড় করে ফোন দিলাম রাখাল রাহাকে। জানলাম, পরদিন ১৯ জুলাই শাহবাগে সকাল দশটায় উনি কয়েকজন অভিভাবকসহ প্রতিবাদ সভার আয়োজন করতে চলেছেন। তাকে বললাম, আমরা জনা বিশ-পঁচিশেক মা-বাবা এক হয়েছি, সভায় অংশ নিতে চাই। উনি আমাদের স্বাগত জানালেন। ... বাড়িতে এ-ফোর কাগজে স্লোগান দিকে ফ্ল্যাটের নিচে জড়ো হয়ে হাতে আঁকা পোস্টার নিয়ে আমরা রওনা হই শাহবাগের দিকে। খুঁজতে থাকি রাখাল রাহাকে। দেখলাম, উনি বেশ গুছিয়ে ভালো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। আমরা কয়েকজন সেই ব্যানার ধরে দাঁড়িয়ে গেলাম জাদুঘরের গেটের সামনে।’
আসফিয়া আজম তার লেখায় পরবর্তী দিনগুলোতে আন্দোলনে অংশগ্রহণের বিবরণ দিয়েছেন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে ২০ জুলাই সেখানে জড়ো হওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও কারফিউয়ের কারণে সমাবেশ সম্ভব হয়নি। ২৬ জুলাই তারা পরীবাগে সমাবেশ করেন। পরবর্তী দিনগুলোতে প্রেসক্লাব, শহীদ মিনার, পলাশীর মোড় প্রভৃতি স্থানে তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সঙ্গে যুক্ত থেকে আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছেন। ৩ আগস্ট তারা শাহবাগে দ্বিতীয়বার সমাবেশে মিলিত হন। লেখিকা বলেন, ‘আমরা ঠিক করলাম, ৩ তারিখে আবার আমরা শাহবাগে দাঁড়াব। এবার আমাদের দাবি আরও জোরালো, অবস্থান আরও শক্ত। আমরা এখন এই খুনি সরকারকে আর চাই না। ১ তারিখ রাত থেকে সারা আফরিন, রাখাল রাহা আর আমি পোস্টার-ব্যানার তৈরিতে নেমে পড়লাম। আমার মেয়ে ও তার বন্ধুদল, চারুকলার একসময়ের ছাত্র আমার এক ভাই মিলে ডিজিটাল পোস্টার তৈরি করল। সারা তৈরি করল শহীদ ছাত্রদের মুখ আঁকা পোস্টার। সকালে প্রিন্ট করলেন রাখালদা। ৩ তারিখ সকালে আবারও শাহবাগ।’ ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় (৩-৮-২৪) প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, অভিভাবকগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন; তাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী সদস্য। তাদের হাতে রয়েছে ডিজিটাল পোস্টার; এগুলোতে রয়েছে এক একজন শহীদের ছবি। ছবির ওপরে লেখা ‘মৃত্যু এত সহজ কেন?’ ও নিচে লেখা ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’। ছবিগুলো ছিল ফাইয়াজ, মুগ্ধ, আবু সাঈদ, রাব্বি প্রমুখের।
উপরের আলোচনা থেকে আমাদের ধারণা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের মধ্যে ‘অ্যাক্টিভিটি’ (ক্রিয়াশীলতা) ও ‘ক্রিয়েটিভিটি’ (সৃষ্টিশীলতা) উভয় গুণ ছিল। আন্দোলন নিজে সক্রিয় থেকে শিক্ষার্থীসহ সকল শ্রেণির নরনারীকে ঘর থেকে রাস্তায় টেনে এনেছে এবং তাদের নানা সৃষ্টিশীল কর্মে প্রণোদনা জুগিয়েছে। কবি লিখেছেন কবিতা, গীতিকার গান, কণ্ঠশিল্পীরা সে গান গেয়েছেন, চিত্রশিল্পীরা এঁকেছেন গ্রাফিতি, কার্টুনিস্ট কার্টুন। শিক্ষার্থীরা রচনা করেছে সেøাগান, মিছিল-সমাবেশে সেগুলো উচ্চারিত হয়েছে। তারা এবং অন্য অনেকে তৈরি করেছেন ব্যানার, প্ল্যাকার্ড ও পোস্টার। মিছিল-সমাবেশে সেগুলো প্রদর্শিত হয়েছে। সব মিলে মনে হবে যেন একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। এ জন্য আমরা বলেছি, পুরো আন্দোলনটা ছিল একটি ‘মহাকাব্য’। মহাকাব্যের মতোই ছিল যেমন বিশালাকার, তেমনি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও তাৎপর্যবাহী। [চলবে]