চার বছর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে নিঃশঙ্কচিত্তে হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তখন খুব কমসংখ্যক মানুষই ভাবতে পেরেছিলেন, তিনি আবারও সদম্ভে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির হাল ধরতে পারবেন। সেই অসম্ভব কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন নানা ঘটনায় আলোচিত ট্রাম্প। ১৩২ বছরের রেকর্ড ভেঙে গত ৫ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদে ঐতিহাসিক জয় পান ৭৮ বছর বয়সী ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামীকাল ২০ জানুয়ারি ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিশ্বের শক্তিধর সেই রাষ্ট্রনায়কের শপথ ও অভিষেক। অভিষেক অনুষ্ঠান উপলক্ষেও ৪০ বছরের রেকর্ড ভাঙতে যাচ্ছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে এক টুইট বার্তায় ট্রাম্প বলেছেন, ‘খুব ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে আমি প্রার্থনা, অন্যদের বক্তৃতা এবং আমার শপথ ও অভিষেক ভাষণটি ইউএস ক্যাপিটল হিলের হলরুমে আয়োজনের নির্দেশ দিয়েছি, যেমনটি ১৯৮৫ সালে রোনাল্ড রিগ্যান করেছিলেন।’
জনাব, ট্রাম্প আপনাকে অভিনন্দন। আপনার জন্য শুভ কামনা। আপনি বিশ্ব শান্তির দূত হয়ে উঠুন। আমরাও আপনার দ্বিতীয় মেয়াদের শাসনকালের সফলতা প্রত্যাশা করছি। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গভীর বন্ধুত্ব আরও সুদৃঢ় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ হোক। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সুন্দর সম্পর্কে ভালো থাকুক বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী নানা সংকটময় পরিস্থিতিতে মার্কিন শাসনব্যবস্থায় বীরদর্পে আপনার প্রত্যাবর্তনে নতুন ইতিহাসের সূচনা হচ্ছে।
বাইডেন প্রশাসনের যুুদ্ধবাজনীতির বাইরে গিয়ে আপনি হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, আগামী ২০ জানুয়ারির আগেই ইসরায়েল-হামাসের মধ্যে যুদ্ধ বিরতির চুক্তি কার্যকর করতে হবে। আপনার সেই কঠিন বার্তায় সুফল এসেছে। গতকাল ১৮ জানুয়ারি শনিবার ইসরায়েলের বিচার মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে অনুমোদন দিয়েছে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভা। তিন ধাপে এই য্দ্ধুবিরতির সমস্ত কার্যক্রম শেষ করার শর্ত রয়েছে চুক্তিতে। এরই অংশ হিসেবে প্রথম ধাপে আজ রোববার ইসরায়েল থেকে ছাড়া পাবেন ৭৩৫ জন ফিলিস্তিনি বন্দি। বিনিময়ে ৩৩ ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেবে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস। খবর সিএনএনের।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের এমন সাহসী নির্দেশনায় বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন বাক তৈরি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্ধু ও শত্রুকে সামলাতে সমানভাবে পারদর্শী ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ ট্রাম্প, যা তাঁকে গত নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভে শক্তি জুগিয়েছে। বিশেষ করেÑ গাজা থেকে গ্রিনল্যান্ড, বিশ্বজুড়ে তাঁর ক্ষমতার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। প্রচলিত কূটনৈতিক নিয়মনীতি পাশ কাটিয়ে তার আসন্ন প্রশাসন এক ধরনের নিবিড় বৈশ্বিক চাপ প্রসারে বিশ্বশান্তিতে কাজ করছে, যা ইতোমধ্যে ফলদায়ক বলে দৃশ্যমান।
এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে বলেছেন, ‘‘ইসরাইল-হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি শুধু নভেম্বরে আমাদের ঐতিহাসিক বিজয়ের ফলে সম্ভব হয়েছে। আমরা হোয়াইট হাউসে না থেকেও অনেক কিছু অর্জন করেছি। আমি যখন ফিরব, তখন যেসব বিস্ময়কর ঘটনা ঘটবে, সেসব কল্পনা করে দেখুন।’’
তবে এটা অস্বীকার করা কঠিন যে, আগামী ২০ জানুয়ারি অভিষেকের আগে ইসরায়েল-হামাস চুক্তি না হলে ট্রাম্পের অঘোষিত হুমকি ‘মূল্য দিতে হবে’। ইসরায়েলি সরকারের মধ্যে যারা ট্রাম্পের প্রতি উৎসাহী সমর্থন দেখাতে আগ্রহী, তাদেরকে অন্তত মাথায় রাখতে হবে, তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে একজন ইসরায়েলি কূটনীতিক মনে করেন, ইসরায়েলের প্রতি ট্রাম্পের অদম্য সমর্থন হঠাৎ কমে যেতে পারে এমন উদ্বেগের মাঝেও ‘ট্রাম্পকে খুশি রাখা’ তার দেশের জন্য ‘জাতীয় স্বার্থের’ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এটি যদিও একটি স্থিতিশীল ঐতিহ্যগত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তির মতো হয়নি, কিন্তু স্বল্প মেয়াদে ট্রাম্প এক্ষেত্রে সঠিক ভূমিকাতেই রয়েছেন।
এছাড়া ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান ইতোমধ্যেই উল্লেখযোগ্যভাবে কার্যকর বলে প্রতীয়মান হচ্ছে শুধু ইসরায়েলে নয়, বৈশ্বিক অন্যান্য বিষয়গুলোতেও। গ্রিনল্যান্ড কেনার জন্য ট্রাম্পের প্রস্তাব নতুন করে আলোচনায় এসেছে। ডেনমার্কের মালিকানাধীন বিস্তীর্ণ হিমায়িত অঞ্চল এবং এর বিশাল খনিজ মজুত নিয়ে কৌশলগত আলোচনায় বসতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। অথচ ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদেই এ পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু তাকে ওই সময় উপহাস করা হয়েছিল।
আসন্ন ট্রাম্প প্রশাসনের উদ্বেগগুলোকে বিবেচনায় রেখে অথবা স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে সরাসরি আলোচনা এড়াতে কিছু দেশ ইতোমধ্যে অগ্রিম উদ্যোগ ও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। উদাহরণস্বরূপ, গত নভেম্বরে মার্কিন নির্বাচনের আগে ২৮ হাজার মার্কিন সৈন্য নিজেদের দেশে রাখার খরচ ভাগ করে নেওয়ার জন্য পাঁচ বছরের চুক্তিতে সম্মত হয় দক্ষিণ কোরিয়া। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের স্মৃতি থেকে সিউল এ চুক্তি নিয়ে আলোচনা তড়িঘড়ি সম্পন্ন করেছিল। প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এশিয়ার প্রধান মিত্র দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন সামরিক শক্তির ওপর বিনা খরচে ভর করার অভিযোগ তুলেছিলেন। সে সময় দেশটিতে মার্কিন সৈন্য মোতায়েনের জন্য বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলার প্রদানের দাবি করেন তিনি। এ ছাড়া ইউক্রেনে রাশিয়ার নৃশংস যুদ্ধ বন্ধে ‘ট্রাম্প ফ্যাক্টর’ পরবর্তীতে অসাধারণ ফলাফল বয়ে আনতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট একবার বলেছিলেন, তিনি একদিনেই সংঘাতের অবসান ঘটাবেন। তবে এখন সহিংসতার অবসান ঘটানোর জন্য আরও গুরুতর প্রস্তাবের ওপর জোর দিচ্ছেন তিনি। ক্রেমলিনের শক্তিধর নেতা ভøাদিমির পুতিন ও বিপর্যস্ত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি উভয়েই সতর্কতার সঙ্গে ট্রাম্পের হস্তক্ষেপের বিষয়কে স্বাগত জানিয়েছেন।
এবার আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানে পতন ঘটেছে শেখ হাসিনা সরকারের। নজিরবিহীন আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তখন রাজনৈতিক নেতৃত্বহীন দেশের কঠিন পরিস্থিতিতে গত ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। গত ৫ নভেম্বর মার্কিন নির্বাচনের কয়েক দিন পূর্বে বাংলাদেশের কঠোর সমালোচনা করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছে এমন দাবি করে টুইটারে পোস্ট করেছিলেন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্প। তিনি তার টুইটে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান এবং অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বর হামলার কড়া নিন্দা জানাচ্ছি। যারা উচ্ছৃঙ্খল জনতার দ্বারা হামলা ও লুটের শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরি বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে।’
ট্রাম্প তার পোস্টে আরও দাবি করেছেন, ‘যদি তিনি প্রেসিডেন্ট থাকতেন তাহলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত নির্যাতনের ঘটনা ঘটত না’।
বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্পের এমন বিস্ফোরক মন্তব্যে দেশে-বিদেশে তখন ব্যাপক আলোচনার জন্মদিয়েছিল। ক্ষমতা হারা আওয়ামীপন্থি লোকজন এতে এক ধরনের স্বস্তি খোঁজার চেষ্টা করেন। অবশ্য মার্কিন নির্বাচনের পরে ট্রাম্প তাঁর ওই বক্তব্য থেকে সরে আসলেও আওয়ামীপন্থি অনেকেই এখনও মনে করেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ইস্যুতে ট্রাম্প নতুন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের প্রেসিক্রিপশন মাথায় নিয়ে বাংলাদেশ ইস্যুতে ট্রাম্প তাঁর নতুন পররাষ্ট্র নীতিতে পরির্বতন আনতে পারেন। কারণ- ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতা ছাড়া, দেশ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ভারতে অবস্থান করছেন। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিশ্ব রাজনীতিতে শেখ হাসিনা আরও বেশি সংকটে পড়ছেন তাঁর পরিবারের সদস্যদের নানা ইস্যুতে। বিশেষ করে, যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিকির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায়। ইতোমধ্যে টিউলিপ সিদ্দিকি পদত্যাগ করেছেন। এই প্রসঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট করেছেন।
টিউলিপের পদত্যাগ সংক্রান্ত মারিও নওফল নামের একজন ‘এক্স’ (সাবেক টুইটার) ব্যবহারকারীর একটি পোস্ট নিজের অ্যাকাউন্টে শেয়ার করেন ইলন মাস্ক। সঙ্গে তিনি লেখেন, ‘লেবার সরকারের শিশুকল্যাণমন্ত্রী নিপীড়নকারীদের সুরক্ষা দেন এবং তাদের দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত।’
অন্যদিকে শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অসঙ্গতির কারণেও চাপের মুখে পড়তে যাচ্ছেন বলে এক নিবন্ধে লিখেছেন কলকাতাভিত্তিক সাংবাদিক মনদ্বীপা ব্যানার্জি। মনদ্বীপা ব্যানার্জি বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘বাবার পাপের দায় ছেলের ওপর পড়ে। তবে এক্ষেত্রে শেখ হাসিনার পাপের দায় পড়েছে তার বোনের মেয়ে টিউলিপের ওপর। এতে করে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এবার এই দায় পড়তে যাচ্ছে তার আপন মেয়ে পুতুলের ওপর। যিনি ২০২৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক হয়েছিলেন।’ এই সাংবাদিক স্বাস্থ্য বিষয়ক জার্নাল ল্যানসেটের ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের একটি সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ওই প্রতিবেদনে পুতুলের প্রার্থীতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। তারা অভিযোগ করেছিল, ‘পুতুল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক হওয়ার যোগ্য না। কিন্তু স্বজনপ্রীতির কারণে তিনি মনোনয়ন পেয়েছেন। এমন স্বজনপ্রীতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করবে।’
ইলন মাস্ক এবং ভারতীয় সাংবাদিক মনদ্বীপা ব্যানার্জি’র মন্তব্যকে বিশ্লেষণ করলে, বাংলাদেশ ইস্যুতে ট্রাম্প নাক নাও গলাতে পারেন।
উপসংহার : বৈশ্বিক রাজনৈতিক টালমাল পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আগামীকাল ২০ জানুয়ারি শপথ নিতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরই মধ্যে ট্রাম্প যুগের সূচনালগ্নে বিশ্বময় শান্তির বাতাস বইছে। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণেও কাজ চলছে। আমরা আশা করব, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে থাকবেন। বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রনায়ক ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকৃত বন্ধুত্বের পরিচয় দেবেন।
লেখক: কলামিস্ট ও সাংবাদিক
ই-মেইল: shamsurjabber@gmail.com


শামসুর রহমান


