মৃত্যুশোক কত প্রকার ও কী কী আমি জানি না। মৃত্যুশোক কত দিন থাকে, তাও আমি জানি না। তবে আমার মতে শোক থাকে মৃত্যু পর্যন্ত।
আমার বাবা মারা গেছেন ২৫ ডিসেম্বর ১৯৮৫, মাত্র ৫৪ বছর বয়সে। ৪০ বছর হয়ে গেছে, এখনো আমি আব্বার জন্য নীরবে চোখের পানি ফেলি আর ভাবি, কবে আব্বার সঙ্গে আমার দেখা হবে বা আদৌ হবে কি না। একইভাবে আমার আম্মা, আমার ছয় ভাইবোন, আমার তিন ভাগনে, আমার দুই দুলাভাইসহ আরও অনেক বন্ধুবান্ধব দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছেন। এতজনের মৃত্যুশোক আমি একা কীভাবে বহন করব? আমি শোকে পাগলের মতো হয়ে গেলাম। সাইকোলোজিস্টের কাছে গেলাম। ডাক্তার মাথা রিলাক্সের ওষুধ দিলেন, যা আমি গত ১৫ বছর ধরে খাচ্ছি। আমি কাউন্সেলিং করি কীভাবে এত ভারী শোক আমি আমার মাথা থেকে বের করব। কারণ আমার দুই ছেলে আছে, স্বামী আছে এবং একটা মানসিক অসুস্থ বোন আছে। আমাকে পুরো পরিবার দেখাশোনা করতে হয়।
মাঝেমধ্যে আমার ডিপ্রেশন অ্যাটাক হয়। তখন আমি সারা দিন বিছানায় পড়ে থাকি। কারণ আমার কিছু করতে ভালো লাগে না। মৃতরা আমার মাথায় ভিড় জমায়। সবাই মাথার ভেতরে কথা বলে। আমি বুঝি এবং ঘুমের ওষুধ খাই। ঘুম থেকে উঠলে আমার মাথা হালকা হয়ে যায়।
মাঝেমধ্যে আমার প্রচণ্ড রাগ হয়, কেন সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেল। আমিও তো ২০২০-তে প্রায় মারা যাচ্ছিলাম। ১০০ দিন হাসপাতালে ছিলাম। ১ বছর প্যারালাইজড ছিলাম। কেন আমি বেঁচে গেলাম?
অনেকেই বলে, সবার দোয়ায় আল্লাহ তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। কেউ বলে, পৃথিবীতে তোমার কিছু কাজ বাকি আছে, তাই আল্লাহ তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। সে সময় মুড়ি-মুড়কির মতো হাসপাতালে মানুষ করোনায় মারা যাচ্ছে আর আমাকে একটা রুমে বন্দী করে রাখা হয়েছে এবং করোনার আগে যে ভাইরাস হয়েছিল, সেটা আমাকে অ্যাটাক করে। করোনার মাঝে থেকেও আমার করোনা হয়নি। এখন আমি মোটামুটি ভালো, তবে কিছু জটিলতা তো আছেই। ডাক্তারদের কাছে নিয়মিত যাই।
যা-ই হোক, আমি শোকের কথা বলছিলাম। কেউ মৃত্যুশোকের মধ্যে থাকলে মানুষ অনেক কথা বলে। আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে, ওনার অত দিন হায়াত ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন আমার মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়। আমার মনের ভেতর যে প্রচণ্ড ব্যথা, সেটা কি কেউ শেয়ার করতে পারবে? যদি না পারে, তাহলে এসব বলে লাভ কী? আমি শোকের মধ্যে অনেকবার পড়েছি এবং ছেলেদের বলে দিয়েছি, কেউ যেন আমার সঙ্গে দেখা করতে না আসে। আমাকে একা থাকতে দাও। আমি আমার শোক একা একা সামাল দেব। আমার কাউকে লাগবে না। আমার সেজো বোন ক্যানসারে মারা যাওয়ার পর আমি পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানিও বের হয়নি। একইভাবে আমার ছোট ভাই যখন ক্যানসারে মারা যায়, তখনো আমি কাঁদতে পারিনি। বুকের ভেতর মনে হচ্ছিল পাথর চেপে বসে আছে। তবে আব্বা, আম্মা, ছোট ভাই পাত্তু, ছোট বোন মেলী মারা যাওয়ার কথা শুনে পাগলের মতো কেঁদেছি। আমেরিকায় আমার ভাই ও বোন মারা যাওয়ার পর আমি কেন জানি প্রচণ্ড রেগে ছিলাম। কেন তারা আমাকে ছেড়ে গেল? আমি একা হয়ে গেলাম। এখনো রাগ হয়, কারণ আমাদের বংশে ক্যানসার নেই, তাহলে কেন তাদের হলো এবং শেষ মুহূর্তে ধরা পড়ে, তখন আর কিছু করার থাকে না। আমার ছোটবেলার বান্ধবী রেবা, সেও ক্যানসারে মারা যায়। আমার প্রিয় মানুষ হুমায়ূন আহমেদ, যার স্নেহে আমি ছিলাম, সেও ক্যানসারে চলে যায়। এত শোক নিয়ে আমি কীভাবে বেঁচে আছি, জানি না।
নিজেকে ভালো রাখতে সব সময় চেষ্টা করি। লেখালেখিতে মন বসাতে পারি না। শুধু ভাবি, আমার মাথার যে অংশে আমার মৃত মানুষেরা আছেন, সেই জায়গাটা যদি বাদ দেওয়া যেত! মাঝে মাঝে স্মৃতি আমাকে পাগল করে দেয়। আমার আব্বা ও ছোট ভাই মারা গিয়েছে বিনা চিকিৎসায়। সেখানে আমি আল্লাহর দোষ দিই না, কারণ অনেকেই বলে আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে। আমার মতে মানুষের ভুলে মানুষ মরে। আল্লাহ আমাদের মগজ দিয়েছেন কেন? কোরআন দিয়েছেন কেন? যাতে আমরা নিজেদের পরিচালিত করতে পারি। এক্সিডেন্টে কেউ মারা গেলে সেটা কার দোষ? ড্রাইভারের বা পথচারীর? সেখানে সান্ত্বনা দিতে আসা লোকজন বলে আল্লাহ নিয়ে গেছে। আমি এটা মানি না। কোনো কিছু ঘটলেই আল্লাহকে আমরা দোষ দেব কেন? শোকার্ত মানুষকে আমি কখনোই সান্ত্বনা দিতে যাই না, কারণ তাতে কোনো লাভ হয় না। চুপচাপ তার পাশে বসে থাকি, তাকে কাঁদতে দিই, যাতে তার বুক হালকা হয়। যদি পাগলের মতো হয়ে যায়, তাহলে হালকা ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই। মানুষের মনের ভেতরের শোককে কখনোই বিদায় করা যায় না। এটা আজীবন থাকে। কেউ প্রকাশ করে, কেউ করে না।
সবশেষে বলতে চাই, পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ নেই, যার মৃত্যুশোক নেই। তবে শোক নিয়ে তো আমরা বসে থাকতে পারি না। না খেয়ে থাকতে পারি না। কাজ করতে হবে। তবে মনের এক কোনায় মৃত্যুশোক ঘাপটি মেরে বসে থাকে। আমি একমাত্র ভালো অনুভব করি, যখন আমি কবরস্থানে যাই। ওদের সঙ্গে কথা বলি। দোয়া পড়ি। অনেক সময় কাটাই। ঢাকায় থাকার সময় প্রতি মাসে বনানী গোরস্থানে যেতাম। কবরে গাছ লাগাতাম। মন ভালো লাগত। চট্টগ্রামে একবার একটা কবরস্থানের গেটে লেখা ছিল, মহিলা ও কুকুর প্রবেশ নিষেধ। খুব খারাপ লেগেছিল লেখাটি দেখে।
মনে আছে, আব্বা মারা যাওয়ার পর একদিন আমি ওনার কবরের সামনে দোয়া পড়ছিলাম। কবর দেখাশোনার একটা লোক ছিল। সে আমাকে বসার জন্য মোড়া এনে দিত। আমার আব্বার পাশের কবরটা একটা মহিলার। তখন আমার পাশ দিয়ে একজন হুজুর যাওয়ার সময় বলে, মহিলা কবরস্থানে আসা ভালো না। আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে ওনার পেছন পেছন যাই এবং জিজ্ঞেস করি, কোথায় এ কথা লেখা আছে মহিলারা কবরস্থানে যেতে পারবে না? তিনি উত্তর না দিয়ে চলে যান। হ্যাঁ, আমি স্বীকার করি, বাসায় বসেও দোয়া করা যায়, তবে কবরস্থানে গেলে আমার শান্তি লাগে। মনে হয়, আব্বার সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে। মাটিতে হাত বোলাচ্ছি। আব্বা আরাম করে ঘুমিয়ে আছেন।
সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ।
-নিউইয়র্ক


মুনিয়া মাহমুদ


