বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশছাড়া করে। গত দেড় দশকে যে কাজটি কেউ করতে পারেনি, আপাতদৃষ্টিতে অসাধ্য সেই কাজটি বাংলাদেশের বিপ্লবী জনতা সম্পন্ন করে বিশ্বকে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেয়। ১৯৭১-এর পর এটা ছিল তাদের বীরত্বগাথার দ্বিতীয় পর্ব। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার এই বিপ্লব বিশ্ব ইতিহাসের এক অনন্য গৌরবের অধ্যায়, যা আগামী দিনে সব অন্যায়-অবিচার ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে বিশ্বের মানুষকে বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করবে।
প্রবাসে বসবাস করায় ঐতিহাসিক এই বিপ্লবে আমার মতো বহু মানুষ সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ না পেলেও সেই বিপ্লব ও তাতে যোগদানকারী বিপ্লবীদের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ ও তাদের মরণপণ সংগ্রামের সাফল্য কামনায় আমাদের হৃদয়মন কখনো একবিন্দু দ্বিধান্বিত হয়নি। ফ্যাসিবাদ উৎখাতের সংগ্রামে বিপুলসংখ্যক মানুষের হতাহতের ঘটনায় আমরা স্তম্ভিত ও বিপদগ্রস্ত হয়েছি এই ভেবে যে, একজন ফ্যাসিস্ট শাসক কেবল নিজে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কতটা নিষ্ঠুর ও নির্মমতার সঙ্গে মানুষ হত্যার জঘন্য হোলি খেলায় মেতে উঠতে পারে। পরে ভেবেছি, একজন ফ্যাসিস্ট শাসক নির্মম-নিষ্ঠুর হবেন-সেটাই তো স্বাভাবিক। তার মধ্যে মানবিক গুণাবলি না থাকারই কথা। ইতিহাস তো সে কথাই বলে। ইতিহাস এটাও বলে, শেষ পর্যন্ত সত্য ও ন্যায়েরই জয় হয়। ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন ঘটে এবং তার জায়গা হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ইতিহাসের এই গতিপ্রকৃতির ব্যতিক্রম হয়নি। হেলমেটধারী দলীয় ক্যাডার, গুন্ডাবাহিনী ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মাঠে নামিয়েও জনমানুষের মুক্তির অদম্য আকাক্সক্ষাকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। তুঙ্গে ওঠা বিপ্লবের বাঁধভাঙা জোয়ারে ফ্যাসিস্ট শাসকের মসনদ খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। অহংকার ও দম্ভভরে ‘শেখের বেটি কখনো পালায় না’ বলা ফ্যাসিস্ট শাসককে জনরোষ থেকে প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। ঘটনা পরম্পরার এহেন অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স (Anti-Climax) বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখে ১৯৬৯ সালে লেখা সম্প্রতি মরহুম কবি হেলাল হাফিজের নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় কবিতার একটি লাইনের কথা মনে পড়ে, ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার এখন শ্রেষ্ঠ সময়।’ প্রকৃতপক্ষে জুলাই বিপ্লবে কেবল যৌবনপ্রাপ্তরাই অংশ নেয়নি, অংশ নিয়েছিল দেশের আবাল-বৃদ্ধ-জনতা।
ফ্যাসিস্ট শাসক বর্তমানে ভারতে অবস্থান করে বাংলাদেশের সরকার, বিশেষ করে ড. ইউনূস ও মানুষের বিরুদ্ধে অবিরাম বিষোদ্্গার ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। সেখান থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীদের হাতের কবজি কেটে দেওয়াসহ সুযোগমতো রাতের আঁধারে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। ফ্যাসিস্ট শাসকের জনৈক দোসরদের বলতে শোনা যায়, আমাদেরকে বাড়িতে শান্তিতে ঘুমাতে ও ঢাকা শহরে নিরাপদে চলাফেরা করতে না দেওয়া হলে অন্যদেরও শান্তিতে ঘুম ও চলাফেরা করা হারাম করে দেওয়া হবে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে ছিনতাই, চুরি-ডাকাতির ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে ফ্যাসিস্ট শাসকের কলকাঠি নাড়ানো যে কাজ করছে, তা বুঝতে কাউকে রাজনৈতিক পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ফ্যাসিস্ট শাসকের আমলে দলীয় মাস্তান ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্থ কামাই করার সুযোগ দেওয়া হয়। সেটা বর্তমানে বহুলাংশে কমে যাওয়ায় তারা ছিনতাই, ডাকাতির মতো বিকল্প পথে অর্থ উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছে। যার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে বিপ্লবীদের ভাবমূর্তি খর্ব করে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানকে মজবুত করা। এসব দুষ্কৃতকারীকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচার করে ১৪ শিকের ভেতরে না পাঠাতে পারলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা কঠিন হবে। ১৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেন। সে সময় মোদি অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তার সঙ্গে বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন ও বাংলাদেশে কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের কল্পকাহিনি সবিস্তারে ট্রাম্পের কাছে তুলে ধরেন। একপর্যায়ে মোদি বাংলাদেশের কথিত গণতান্ত্রিক সরকার পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্পবিরোধী একটি বিশেষ মহলের (Deep State) মদদ রয়েছে বলে অভিযোগ করেন। ট্রাম্প মোদির মুখের ওপর এই অভিযোগ নাকচ করে দেন।
ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক শেষে মনঃকষ্ট নিয়ে হোয়াইট হাউস-সংলগ্ন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ব্লেয়ার হাউসে ফেরার পথে মোদি সেখানে একদল বাংলাদেশিকে প্ল্যাকার্ড, ব্যানার নিয়ে বাংলাদেশের সরকারবিরোধী বিক্ষোভরত অবস্থায় দেখতে পান। বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, সেখানে লেখা ও মুখে উচ্চারিত স্লোগানের মধ্যে অন্যতম ছিল We support Modiji, Step Down killer Yunus.
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও নিউইয়র্কভিত্তিক হিন্দু লাইভস ম্যাটারের লোকজন বিক্ষোভে অংশ নেন। হিন্দু লাইভসের লোকদের ট্রাম্প ও মোদির প্রতি প্রেম-ভালোবাসা থাকাটা স্বাভাবিক মনে হলেও যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি, যিনি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও কমিউনিটিতে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত, তার মুখে ‘মোদিজি’ উচ্চারণ শ্রুতিকটু ও বেমানান ঠেকেছে। মোদি কখনোই বাংলাদেশের বন্ধু ছিলেন না, যা বিগত দিনে তার বহু কর্মকাণ্ডে সুপ্রমাণিত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবময় ভূমিকাকে ভুলে গিয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সব কৃতিত্ব ভারতীয় সেনাদের দেন। এ রকম একটি মানুষকে ‘মোদিজি’ বলে সম্বোধন করা আত্মমর্যাদাহানিকর ও নতজানু মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ হওয়ায় আমরা অনেকে অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছি।


বাহারুল আলম


