শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিক্রান্ত হলেও মূলত এবং প্রধানত বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকে। সামন্ত যুগের গোড়াপত্তন, বুদ্ধিমত্তা চর্চা আন্দোলন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনা এ দ্বি-সমান্তরাল চলমান ধারায় অব্যাহত অনিবার্য বিবর্তনের ফলে বাংলার মৃত্তিকার স্তরে স্তরে সাংস্কৃতিক সম্ভানায় উর্বরতার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল।
সে বাস্তবতার নিরিখে ইতিহাসের যথার্থ অনুসন্ধানে দেখা যায়, নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি নির্মম বঞ্চনার কশাঘাতে জর্জরিত জনগোষ্ঠী হতাশার নিবিড়ে কঠিন অচলায়তনে বন্দী যুগের পর যুগ। সেই অচলায়তনের নিষ্ঠুর জাঁতাকলে নিষ্পেষিত এই জনগোষ্ঠী মুক্তির সন্ধান করতে থাকে নিরন্তর। ভাবে, তত্ত্বে, সংগ্রামে এবং অতীন্দ্রিয় সত্ত্বার উৎকর্ষের আলোকে। তৎকালে সমকালীন সমাজ দর্শনে এক যুগান্তকারী জাতি, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে বিশেষ একটি গোষ্ঠী ক্রমশ তৈরি হয়, যুক্ত হয় বাংলার মাটিতে। নিমজ্জিত জীবনের মুক্তির খোঁজে ভিন্নতর এক সাধনার তত্ত্ব ও ব্রত নিয়ে। সে সাধনা বাউলসংগীত ঘরানার বিশাল ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ অন্য রকম এক অনন্যসাধারণ মানবিক জীবন। কাব্যিক ছন্দ সুরের জগৎ। বৈষয়িক বস্তুবাদের নির্মোহ শ্বেতশুভ্র জীবন পরিক্রমায় পরমাত্মার সন্ধানে ধ্যানে নিমগ্ন বৈরাগ্য সাধনে অবলীলায় কাক্সিক্ষত ভাবতত্ত্ব মহাসাগরের অতল জলে ডুবে অনুসন্ধান করে প্রেমরতন। জীবনের সেই অখণ্ড বিশালতাকে ধারণ করে কিন্তু অতিক্রম করতে পারে না। সে জন্য বাউলতত্ত্ব জীবনবোধের সর্বশ্রেষ্ঠ স্তরে আটকে থাকে পরমাত্মার সন্ধানে পথহারা দিশাহীন ক্লান্ত পথিকের পরিচয়ে গবেষণায় আত্ম অনুসন্ধানের সামগ্রিক কর্মযজ্ঞে।
একটা শতাব্দীজুড়ে অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দীতে ফকির লালন বাউলতত্ত্বের বিশুদ্ধ এবং স্বচ্ছ কাব্য গীতিময়তার সংগীতে বাঙালি জাতিকে নব উদ্দীপনায় উজ্জীবনের উচ্চতর চেতনাবোধের সন্ধান দিয়েছিলেন। তার সামগ্রিক দর্শনে একই সঙ্গে জীবনবোধ ও আধ্যাত্মিক চেতনাবোধে কঠিন এবং কোমলের নির্যাসে উচ্চতর আকাক্সক্ষা যুক্ত হয়েছিল নীরবে, নিভৃতে, জীবনের পরতে পরতে।
পরমাত্মার রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে তিনি অবলীলায় বলেছেন, ‘ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে’ কিংবা ‘বাড়ির পাশে আরশিনগর’। ভাবে বর্ণনায় দেহতত্ত্বের বিশাল সম্ভারকে তিনি বলেছেন, ‘দেহের মাঝে বাগান আছে, সে বাগানে ফুল ফুটেছে।’
ছান্দসিক ও সাধারণের জন্য সহজবোধ্য উপমা, রূপক ভাবসমগ্রে ভাবনার জগতে যে ঝড় তুলেছিলেন, তা এখন সঞ্চারিত হয় কাল থেকে কালে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। উন্নততর জীবনের প্রেক্ষিতে, সুললিত চিন্তার আরও একধাপ সম্প্রসারণ, নশ্বর এবং অবিনশ্বরতার রহস্যের নিবিড় তত্ত্ব প্রকাশের প্রয়াসে নিরন্তর সচেষ্ট ছিলেন লালন।
তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে লালনচর্চা, দর্শন এবং অনুসন্ধানের গবেষণা অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই। পরিশেষে বলা যায়, বাঙালি জাতিকে লালন চিরঋণী করে রেখেছেন।
-নিউইয়র্ক