Thikana News
১৯ জুন ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫

আদনান সৈয়দ

আদনান সৈয়দ



 
সেদিন আমার এক বন্ধু কিছুটা ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাই, বাংলা মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত বইয়ের ভবিষ্যৎ কী? বইয়ের পাঠক কি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে? আমাদের নতুন প্রজন্ম কি আর বই পড়বে না?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই থেকে বিষয়টা নিয়ে আমিও ভাবছি। সত্যিই কি বাংলা বইয়ের পাঠকসংখ্যা আগের চেয়ে কমে গেছে? বইয়ের ভবিষ্যৎ কি খুব খারাপ? আমেরিকায় গড়পড়তা সবাই মোটামুটি বই পড়েন। তারা বইকে জীবনের সঙ্গী করে নিয়েছেন। বই ভালোবাসে না এখানে এমন লোক পাওয়া খুব কঠিন।

আমেরিকার রাস্তার ফুটপাতে বসে, বাসে, পাতাল ট্রেনে, পার্কের বেঞ্চে এমনকি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও এই বইপাগল মানুষগুলো বইয়ের রসে নিজেদের ডুবিয়ে রাখেন। কিন্তু গড়পড়তা বাঙালি কি বই পড়েন? নাকি তারা বই নামক বস্তুটি থেকে তাদের মুখ তুলে নিয়েছেন? বই কি শুধুই একটি পণ্য? জানি, আপনি হয়তো ফস করে জবাব দেবেন, ‘ভাই, পড়ার সময় কোথায়?’ বটে! জ্যাকসন হাইট‌সে চা-শিঙাড়া নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা আর তর্ক-বিতর্ক করতে পারবেন কিন্তু একটা বই হাতে নিয়ে দেখার সময় আপনার হয়ে ওঠে না। আজ থেকে প্রায় এক শ বছর আগে সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত ‘বইকেনা’ রম্য রচনাটির কথা আবার নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। 

আমরা ছেলেবেলায় দেখেছি, সেই সময় উপহার হিসেবে সেরা বস্তুটি ছিল বই। জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী থেকে শুরু করে বাঙালির বিভিন্ন উৎসবকে ঘিরে সর্বত্রই ছিল বইয়ের সগৌরব উপস্থিতি। এখন সময় পাল্টেছে। বাঙালির হৃদয় আর মননের বিকাশ ধীরে ধীরে আরও বিকশিত হয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি বিকৃত বাংলা উচ্চারণ, ঝাকানাকা সংগীত (রবীন্দ্রসংগীত পর্যন্ত রিমিক্স হয়ে গেছে), বিভিন্নভাবে সংস্কৃতির পিণ্ডি চটকানোর কাজটিও ইদানীং বেশ চোখে পড়ছে। তবে আশার কথা হলো, এই কঠিন সময়ের মধ্যেও অনেকেই ভালো কিছু কাজ নিত্যই করে যাচ্ছেন। হয়তো সে কারণেই আমরা এখনো ভরসা পাই, এখনো স্বপ্ন দেখি।

তবে এ কথা ঠিক, ইদানীং মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত বইয়ের ভবিষ্যৎ ও অস্তিত্ব নিয়ে অনেকের কপালেই চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। অনেকেই ভেবে আশঙ্কায় আছেন, তাহলে কি ভবিষ্যতের পৃথিবী থেকে বই নামের এই ছোট্ট বস্তুটি সত্যিই হারিয়ে যাবে? বই কি সত্যিই এখন অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে? এ কথা সত্য, বইয়ের জায়গা এখন দখল করে বসে আছে ফেসবুক, ইন্টারনেট চ্যাট, ইনস্টাগ্রাম, ভিডিও গেম, রং-বেরঙের টিভি চ্যানেলসহ নানা মাধ্যম। দেখা যাচ্ছে, বই এখন বাসা বাঁধতে শুরু করেছে আইপ্যাডে, কিন্ডেলে কিংবা গুগল বুকে। আর কাগজের বইগুলো এখন নীরবে ঘুমোচ্ছে বাড়ির ড্রয়িংরুমের বড় বড় আলমারির তাকে অথবা কখনো কখনো বস্তাবন্দী হয়ে। আলমারির তাকে বইয়ের মলাটের এখানে-ওখানে ঝুলছে মাকড়সার জাল আর সেখানে জমছে ধুলোর সাদা আস্তরণ। বই এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। বই কি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে? কথাটা শুনে লাফিয়ে উঠেছিলেন প্রয়াত কবি শহীদ কাদরী, ‘আরে মিঞা, বই কি কখনো ঘুমায়? কখনো ঘুমোতে পারে? বই জেগে থাকে আর জেগে থাকবে চিরদিন। এই বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির যুগে বই হয়তো ভিন্ন চেহারায় ভিন্নভাবে পাঠকের সামনে এসে ধরা দিচ্ছে। বই কখনো মুছে যায় না, হারিয়ে যায় না। বইয়ের অস্তিত্ব আগেও যেমন ছিল, এখনো তেমনি আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।’
কিন্তু আমার মাথায় প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাই আবার কবির কাছে প্রশ্ন, ‘ধরা যাক, আজ থেকে ৫০ বা ১০০ বছর পর বাঙালি আত্মায় কি বই সত্যি টিকে থাকবে?’ শহীদ কাদরীর উত্তর ছিল, ‘দেখো মিঞা, সাহিত্যের সঙ্গে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির আমি কোনো বিরোধ দেখি না। সাহিত্য আমাদের মন আর মননকে সমৃদ্ধ করে। আমাদের আত্মার খোরাক জোগায়। আর বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কাজ কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানুষের মেধা যে কত দূর এগিয়ে যেতে পারে, তা বিজ্ঞান না পড়লে বোঝা যায় না। আমাদের নিত্যদিনের জীবনে প্রযুক্তির অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। একসময় যখন টিভি এল, তখন আমরা অনেকেই ভেবেছিলাম, মানুষ হয়তো আর সিনেমা দেখবে না। কিন্তু টিভির জন্য সিনেমার আবেদন কোনোভাবেই কমে যায়নি। বইপড়াটা হলো একটা অভ্যাসের বিষয়। একটা ভালো লাগার জায়গা। আর সে কারণেই আজ থেকে শত বছর পরেও বই থাকবে।’

আজ থেকে বছর দশেক আগেও জ্যাকসন হাইট‌সে ‘অবকাশ’, ‘অনন্যা’, অবসর’ নামে কিছু বইয়ের দোকান ছিল। এখন সব কটা দোকানই কালের ইতিহাসে বিলীন হয়ে গেছে। এখানে অনেক ব্যবসায়ী বই নামের বস্তুটির জন্য লগ্নি করতে গিয়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন। সেই বইয়ের দোকানগুলোতে এখন বইয়ের জায়গা দখল করেছে স্যুটকেস, সিরামিকের বাসন-কোসন, মাছ কাটার বঁটি, শিল-পাটা ইত্যাদি ইত্যাদি। নাহ, আমি এর জন্য কোনো পুস্তক ব্যবসায়ীকে দায়ী করছি না। জ্যাকসন হাইট‌সে এখনো যে বইয়ের দোকানটি দাঁড়িয়ে আছে, তার নাম ‘মুক্তধারা’। মুক্তধারায় যখন সময় কাটাই, তখন সেখানে বইয়ের ক্রেতার চেয়ে অডিও-ভিডিওর ক্রেতাই বেশি দেখি। বইয়ের তাকগুলো যেন তালগাছের মতো মাথা উঁচু হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। না, সেখানে বইপ্রেমীদের আনাগোনা নেই, বই পাওয়ার জন্য কারও মাঝেই কোনো আকুলতা চোখে পড়ে না। যদি বলি মুক্তধারা বইয়ের দোকানটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে শুধু মালিক বিশ্বজিৎ সাহার বইয়ের প্রতি ভালোবাসার কারণে, তাহলে কথাটা কোনোভাবেই বাড়িয়ে বলা হবে না। মুক্তধারা শুধু বইকে হাতের কাছে পৌঁছে দেয়নি, পাশাপাশি নিউইয়র্কের বাঙালি আত্মায় গত ২৭ বছর ধরে একটি অসাধারণ বাংলা বইমেলারও বীজ বপন করতে সমর্থ হয়েছে।

ছেলেবেলায় দেখেছি, একটা বই ছিল আমাদের জীবনে সবচেয়ে বড় উপহার। জন্মদিন বলুন বা কোনো বিশেষ দিন, সেখানে বই নামের এই ছোট্ট শব্দটা যেন আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। কাউকে কিছু উপহার দিতে বইয়ের কোনো বিকল্প ছিল না। আর বই হলো নেশার মতো। চা খাওয়া, সিনেমা দেখা বা সাঁতার শেখার মতোই বইপড়া একটা নেশা। আর এই নেশাটা তৈরি করতে হয় ছেলেবেলা থেকেই। বইয়ের সঙ্গে নিত্য বন্ধুত্ব, বইয়ের সঙ্গে বসবাস করতে করতেই এই নেশাটা ঠিক ধরে যায়। কিন্তু এই বই নেশাখোরেরা এখন কোথায়? প্রতিবছর বাংলাদেশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রচুর বই প্রকাশিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে আমরা প্রতিদিনই নতুন নতুন লেখক-পাঠক পাচ্ছি। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ‘বইয়ের পাঠক সেই সঙ্গে বেড়েছে কি?’

বই নিয়ে শেষ কথা বলার আদৌ কি কিছু আছে? মার্ক টোয়েনের কথাটাই তাহলে শেষ কথা। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে, ‘Twenty years from now you will be more disappointed by the things that you didnÕt do than by the ones you did do. So throw off the bowlines. Sail away from the safe harbor. Catch the trade winds in your sails. Explore. Dream. Discover.’
বইয়ের মৃত্যু নেই। বই থাকবে আমাদের আশপাশেই। কুড়ি বা পঞ্চাশ বছর কিংবা শত বছর পর বইয়ের দশা কী হবে, সে ভাবনা সময়ের হাতে তুলে দিয়ে এ কথা চোখ বুজেই বলে দেওয়া যায়, পাঠকের অন্তরের তৃষ্ণাই বইকে নিত্য বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল। তবে আমাদের যে কাজটি করতে হবে তা হলো, জীবনের সব রকম আয়োজনের সঙ্গে বইকে সম্পৃক্ত করা। এভাবেই শুরু করা যেতে পারে বইপড়ার নীরব বিপ্লব।
বইয়ের জয় হোক, বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতির জয় হোক এবং সেই সঙ্গে এই প্রবাসের কঠিন পাথুরে মাটিতে দাঁড়িয়ে যারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চাষবাসে নিজেদের নিবেদন করেছেন, তাদের প্রচেষ্টাও সফল হোক, সেই কামনা করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার এবং অনুবাদক।
 

কমেন্ট বক্স