আগুনে কেবল পানি নয়, ছানা-মাখনও ঢেলে দিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত কয়েক দিন ধরে প্যাঁচ লাগানো জুলাই বিপ্লবের আইনি ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির কথা দিলেন। সেই সঙ্গে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা। বিএনপি এতে সবচেয়ে বেশি ফুরফুরে। ভাষণে তিনি বাড়তি যোগ করলেন প্রবাসীদের কথাও। প্রবাসীদের প্রশংসা করে বলেছেন,
অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ যে আবার দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে, তার বড় কারণ প্রবাসীরা। স্পষ্ট করে জানালেন, নির্বাচনে রেমিট্যান্স-যোদ্ধাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ভাষণে প্রবাসীদের প্রশংসা করলেও জুলাই সনদে প্রবাসীদের অবদান লিপিবদ্ধ হয়নি। এ কারণে প্রবাসীরা ব্যথিত, হতাশ, ক্ষুব্ধ।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অর্থাৎ রোজার আগে নির্বাচন আয়োজনে ইসিকে চিঠি দেবেন বলে জানান ড. ইউনূস। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইসি থেকে জানানো হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী আগামী রোজার আগেই ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে ইসি প্রস্তুত। তফসিল ঘোষণা হবে ডিসেম্বরে। জাতির উদ্দেশে ভাষণের আগে ঝুমবৃষ্টি মাথায় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ধারণাতীত আয়োজন ‘৩৬ জুলাই উদ্যাপন’। জামায়াতের সহযোগী সংগঠন সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু। এরপর কলরব শিল্পীগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন ব্যান্ড ও শিল্পীদের পরিবেশনা। এক অন্য রকম আবহ।
কেবল মঙ্গলবার নয়, গেল কয়েক দিন ধরেই ৫ আগস্ট নিয়ে চলেছে নানা গুজব-গুঞ্জন ও নেগেটিভ ন্যারেটিভ। শিগগিরই সেনাশাসন আসছে, ৫ আগস্ট বিএনপিসহ কয়েকটি দল ৩৬ জুলাই উদ্যাপন অনুষ্ঠানে যাচ্ছে না, দিনটিতে হরতাল ডাকতে পারেÑএমন অন্তহীন গুজব ও উৎকণ্ঠায় ভেসেছে দেশ। সেখানে টেনে আনা হয়েছে মার্কিন সাবেক প্রভাবশালী রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকেও। বলা হয়েছে, পিটার হাস কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। হাসনাত-সারজিসসহ এনসিপির নেতারা ঢাকায় এত বড় অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে কক্সবাজারে পিটার হাসের সঙ্গে গোপন বৈঠক করছেন। স্থানীয় বিএনপির নেতারা কথিত ওই হোটেলও ঘেরাও পর্যন্ত করেন। গোটা দেশের চোখ চলে যায় কক্সবাজারের দিকে। দিনের মধ্যভাগে মালুম হয় পুরো ব্যাপারটিই ভুয়া। পিটার হাস আছেন ওয়াশিংটনে।
পিটার হাসের সঙ্গে কক্সবাজারে এনসিপি নেতাদের বৈঠকের খবর বেশ কয়েকটি টেলিভিশন এক্সক্লুসিভ করে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করেছে। পরবর্তীতে দাবি করা হলো, এনসিপির এই শীর্ষ নেতারা নাকি সেখানে স্রেফ ‘ঘুরতে’ গেছেন। এর পরও প্রশ্ন পিছু ছাড়েনি। জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ ফেলে কেন কক্সবাজার যাওয়া নির্বাচন পেছানোর দাবি করা দল এনসিপির শীর্ষ নেতাদের? কেন জেলা পুলিশকে অবহিত না করে তড়িঘড়ি ৬ নেতার একত্রে কক্সবাজার যাওয়া? কীভাবে, কেন পুলিশের আইজিপির স্ত্রীর মাধ্যমে জেলা পুলিশকে না জানিয়ে বরং এসবি পুলিশ থেকে প্রটোকল? বলার অপেক্ষা থাকছে না, তাদের সফরটি কোনো স্বাভাবিক সফর ছিল না। এ নিয়ে নানা নেগেটিভ ও ফ্ল্যাশব্যাকের মাঝেই ডক্টর ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচনের কথা জানান। তার এক ভাষণেই বদলে যায় রাজনীতির গতিধারা।
ফ্যাসিস্ট শাসনের পতন ও শেখ হাসিনার পালানোর ৫ আগস্টকে ঘিরে ৩৬ জুলাই আয়োজন সামনে রেখে গোটা দেশকে অস্থির করে দেওয়া হয় গত এক সপ্তাহ ধরে। আয়োজকেরা সাময়িক সফলও হন। অবশেষে সব আয়োজন মার খায় মারাত্মকভাবে। একমাত্র সিপিবি বাদে বাম-ডানের সব দলের নেতারা ছাতা মাথায় একে একে পৌঁছে যান মানিক মিয়ায়। কোলাকুলি-গলাগলির প্রতিযোগিতা চলে গত কদিন নানা তিক্ত কথায় মশগুল নেতাদের মধ্যে। জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠের বিশাল এ আয়োজনের পর রাতে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণে সোজা বাংলায় জানিয়ে দেন, ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগেই নির্বাচন। কোনো তবে, কিন্তু, যদি যোগ না করে খোলাসা করে জানিয়ে দেন সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন এই তিনটিই তার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ। তার ভাষায় : ‘এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা। নির্বাচন অনুষ্ঠান। আজ এই মহান দিবসে আপনাদের সামনে এ বক্তব্য রাখার পর থেকেই আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করব। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব।’
বিএনপিসহ কয়েকটি দল এমন একটি বার্তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। সেই সঙ্গে বলছিল আক্রমণাত্মক নানা বাজে কথা। বিএনপি-জামায়াত-এনসিপিসহ কয়েকটি দল শুধু বাজে কথা নয়, নানা আজেবাজে ঘটনায়ও জড়িয়ে পড়ে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এর তিন দিনের মাথায় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। নির্বাচনের দাবি নিয়ে আন্দোলন-কর্মসূচিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ দেখা দিলে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন ড. ইউনূস। গত ১৩ জুন ওই বৈঠকের পর এক যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে হবে জাতীয় নির্বাচন। এরপর জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির দিনে ফেব্রুয়ারি মাসে রোজা শুরুর আগে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে নির্বাচনের কথা পরিষ্কার করলেন প্রধান উপদেষ্টা। সুন্দরভাবে নির্বাচন করে এ দেশের সব নাগরিক একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার কাজে সফলভাবে এগিয়ে যেতে পারে, সে জন্য সবার কাছে দোয়া চান তিনি। এবারের নির্বাচন যেন আনন্দ-উৎসবের দিক থেকে, শান্তি-শৃঙ্খলার দিক থেকে, ভোটার উপস্থিতির দিক থেকে, সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতার দিক থেকে দেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকে, সেই অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেন।
আরও বলেছেন, ‘এবারের নির্বাচনে তরুণেরা জীবনে প্রথমবার ভোট দিয়ে তাদের এই দিনটি স্মরণীয় করে রাখবে। এর মধ্যে এমন ভোটার থাকবে, যারা ১৫ বছর আগে থেকেই ভোট দিতে পারত, কিন্তু জীবনে একবারও ভোট দিতে পারেনি। এর মধ্যে আসবে, যারা ১০ বছর আগে, ৫ বছর আগে ভোট দিতে পারত, কিন্তু পারেনি। আর আসবে ভাগ্যবান ও ভাগ্যবতীর দল, যারা এই প্রথমবার ভোটার হওয়ার যোগ্যতা লাভ করল এবং সঙ্গে সঙ্গে ভোট দেওয়ার সুযোগও পেয়ে গেল।’ সবাইকে বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বানও জানান।
প্রধান উপদেষ্টার এ ভাষণের এক দিন আগে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছিলেন, দেশে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তার আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলও জানিয়েছিলেন একই শঙ্কা। আপাতত সেই শঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হলো প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে। এর ঘণ্টা কয়েক আগে জুলাই ঘোষণাপত্রে অতীতের বেশ কিছু লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস যুক্ত করেছেন। ঘোষণার ২৮ দফা টেক্সটে বিগত আন্দোলনের প্রায় সব দিকই এসেছে। একসময় জনসাধারণের আড্ডাস্থল, মৃত এমপিদের রাষ্ট্রীয় জানাজার জায়গায় বৃষ্টিস্নাত বিকেলে মনোরম মঞ্চে দেওয়া ঘোষণার ওপর নির্ভর করছে আগামী রাজনীতির অনেক কিছু। ড. ইউনূস সম্ভবত ক্ষমতা হাতে নেওয়ার পর এই প্রথমবার খোলা হাওয়ায়, রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিলেন। ১৯৪৭ সালের আগস্ট, ১৯৭৫ সালের আগস্ট, ২০২৪ সালের আগস্ট এবং ২০২৫ সালের আগস্ট ইতিহাসের মাইলস্টোন হয়ে গেল। জাতির উদ্দেশে ভাষণের আলোকে কারও কারও দৃষ্টিতে ড. ইউনূস প্রবাসীদের দিকে বেশি ঝুঁকে গেলেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রসঙ্গ বেশি করে উল্লেখের মাঝে তারা কিছু কিন্তু দেখছেন।
প্রবাসে থেকেও বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ৫৭ জন বাংলাদেশির যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমিরাতের বাদশাহকে ফোন করে তাদের সাজা ক্ষমা করিয়েছিলেন। রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে হাসিনার ভিত্তি নড়বড়ে করে দিয়েছিলেন। প্রবাসীদের এই ত্যাগ ও অবদান তিনি উল্লেখ করেছেন ভাষণে। তবে ঘোষণায় আসেনি। যেকোনো বিষয়ে কথামালায় অভ্যস্তদের মাঝে প্রধান উপদেষ্টার জুলাই ঘোষণা ও ভাষণ নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে। কোরআন তেলাওয়াত দিয়ে শুরু না করলেও ঘোষণা পাঠ শুরুতে আল্লাহর রহমত কামনা এবং বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলেছেন।
শেষ প্যারায় রয়েছে পরবর্তী সরকারের এই ঘোষণাপত্র সংবিধানে সংযোজন করার কথা। এ ঘোষণার একটিই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা হলো দায়মুক্তি। ৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত যেসব গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেসবকে বিচারের আওতামুক্ত রাখার সনদ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ইনডেমনিটি বাতিলের দৃষ্টান্ত রয়েছে। সামনের নির্বাচিত সরকার তা রক্ষা করবে কি না, সেটি অপেক্ষার বিষয়। তবে ফ্যাসিস্টের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। জাতির উদ্দেশে দেওয়া বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘গত বছরের গণঅভ্যুত্থান ছিল দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, দুঃশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট, গুম, খুন, অপহরণ, ভোটাধিকার হরণসহ সব ধরনের অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম ও আপামর জনতার ক্ষোভের বিস্ফোরণ।’ বলেছেন, চিরতরে ফ্যাসিবাদ নির্মূলের কথাও। এর মধ্য দিয়ে বহুদিন পর গণমাধ্যমের শিরোনামে এলেন তিনি। এর জের, ভিন্ন ন্যারেটিভ বা নেপথ্য অন্য কোনো তথ্য আসে কি না, সেই অপেক্ষমাণ উৎসুক মহলও রয়েছে। যা হিন্দি সিরিয়ালের চেয়েও জটিল। চুপ্পু বাস্তবতা উপলব্ধি করেছেন, না তাকে দিয়ে কাজটি করানো হয়েছে- এ ফ্ল্যাশব্যাক রচনায় ব্যস্তজনও আছেন।