কানাডার টরন্টো শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে ইটোবিকো এলাকা। এখানে কনডোমিনিয়ামের তিনতলায় থাকে এক ঘাতক; যে কি না ৪৮ বছর আগে নিজ হাতে খুন করেছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে আত্মগোপনে থানা ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে এই প্রথম প্রকাশ্যে দেখা গেছে। তাকে খুঁজে বের করেছে কানাডার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল সিবিসি।
১৭ নভেম্বর শুক্রবার রাতে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি এসএইচএমবি নূর চৌধুরীকে নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সিবিসির জনপ্রিয় অনুসন্ধানী বিভাগ ‘দ্য ফিফথ স্টেট’। ‘দ্য অ্যাসাসিন নেক্সট ডোর’ শিরোনামের ৪২ মিনিটের এই প্রতিবেদনে নূর চৌধুরীর কানাডায় পালিয়ে যাওয়া, ২৭ বছর সেখানে থেকে যাওয়া এবং খুনের অভিযোগে হওয়া শাস্তি বাস্তবায়নে তাকে বাংলাদেশের ফেরত চাওয়ার বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
নূর চৌধুরী কোথায় আছে–এ নিয়ে জানা থাকলেও তথ্য আকারে সামনে আসেনি। তার অবস্থান নিয়ে একধরনের ধোঁয়াশা তৈরির প্রচেষ্টা ছিল। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর সেই ধোঁয়াশা আর রইল না।
সিবিসির প্রতিবেদন মতে, নূর চৌধুরীর অবস্থান শনাক্ত করতে তাকে দীর্ঘদিন অনুসরণ করে সিবিসি টিম। একসময় কানাডার টরন্টো থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে ইটোবিকো এলাকায় তার বসবাসের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যায়। সেখানে একটি কনডোমিনিয়ামের তিনতলায় থাকে বঙ্গবন্ধুর এই খুনি। ৭০ বছর বয়সী নূর চৌধুরী প্রতিদিন বিকালে বারান্দায় আসে। কানাডায় মুক্তভাবে জীবনযাপন করলেও প্রথমবারের মতো ক্যামেরায় দেখা যায় তাকে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, গাড়ির ড্রাইভিং সিটে নূর চৌধুরী। পাশে আরেকজন। নূরকে দেখে ক্যামেরা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন সিবিসির প্রতিবেদক। তাকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়। তখন নূর চৌধুরী ১/২ সেকেন্ড সময় চায় প্রস্তুত হতে। পরক্ষণেই গাড়ি টান দিয়ে চলে যায় সে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করে নূর চৌধুরী। সাজার বদলে ৭৫-পরবর্তী সরকার ব্যবস্থাগুলো থেকে পুরস্কৃত হয় এই খুনি। কূটনীতিক হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালন করে সে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে, তখন পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে যায় নূর চৌধুরী। পরে দর্শনার্থী হিসেবে সে কানাডায় প্রবেশ করে। ১৯৯৯ সালে শরণার্থী হিসেবে থেকে যাওয়ার আবেদন করলেও কানাডা সরকার তা নাকচ করে দেয়। আপিল করেও হেরে যায় নূর চৌধুরী।
২০০৯ সালে কানাডা থেকে নূর চৌধুরীকে বের করে দিতে নির্দেশ দেন কানাডার সর্বোচ্চ আদালত। বাংলাদেশে পাঠালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে পারে– শঙ্কার বিষয় জানিয়ে ২০১০ সালের দিকে দেশটির সরকারের কাছে ‘প্রি রিমুভাল রিস্ক এসেসমেন্ট’র আবেদন করে নূর চৌধুরী। যেহেতু কানাডা মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না, সেহেতু এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রায় ১৪ বছর ধরে সেখানে মুক্ত জীবনযাপন করছে সে।
যা আছে প্রতিবেদনে
দীর্ঘদিন ধরে কানাডায় নূর চৌধুরীর মুক্ত জীবনযাপন এবং খুনের দায়ে সাজা বাস্তবায়নে তাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার ও কানাডার বাংলাদেশ দূতাবাস তৎপর রয়েছে। সাক্ষাৎকারে নিজ বাবার খুনির বিচার চেয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিভিন্ন মত দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মামলার আইনজীবী ও বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আকন্দ বরাত। এ ঘটনার সুরাহা চেয়েছেন কানাডার বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী স্টকওয়েল ডে। নূরকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে সোচ্চার অবস্থান তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের হাইকমিশনার ড. খলিলুর রহমান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘কানাডা খুনিদের মানবাধিকার দেখছে, কিন্তু আমার বা আমাদের স্বজনদের মানবাধিকার দেখছে না।’
কানাডার বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী স্টকওয়েল ডে বলেন, ‘এটা ৫০ বছর আগের ঘটনা হলেও সুরাহা হওয়া উচিত।’
প্রতিবেদনটিতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মামলার আইনজীবী ও বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আকন্দের বরাতে ও বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণের মাধ্যমে দেখানো হয়–কীভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল নূর চৌধুরী।
কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার ড. খলিলুর রহমান বলেন, ‘এই একটি ইস্যু ছাড়া কানাডার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। কেবল বাংলাদেশি হাইকমিশনার হিসেবে নয়, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি চাই তাকে (নূর চৌধুরী) বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হোক।’
সিবিসির এই প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন চ্যানেলটির অনুসন্ধানী সাংবাদিক বাংলাদেশি নাগরিক আবদুল্লাহ আল ইমরান। প্রতিবেদন তৈরি প্রসঙ্গে নিজের ফেসবুক পোস্টে ইমরান লিখেছেন, ‘গত ৭ মাস আমরা ছুটে বেরিয়েছি অটোয়া থেকে টরন্টো, টরন্টো থেকে ঢাকা। পড়েছি শত শত কোর্ট ডকুমেন্টস। জোগাড় করেছি দুই দেশের গোপন নথি। জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করেছি, নূরকে বাংলাদেশের আইনের মুখোমুখি করতে না পারার দায় কি শুধু কানাডা সরকারের পলিসির, নাকি আরও অন্য কিছু আছে?’
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের নভেম্বরে সচিবালয়ে আসেন কানাডার হাইকমিশনার লিলি নিকোলস। সাক্ষাতের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কানাডার আইনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ফেরত দেওয়া সম্ভব নয় বলে আমাকে হাইকমিশনার জানিয়েছেন। আমি তাদের অনুরোধ করেছি, বিকল্প পন্থা বের করা যায় কি না। তাকে বলেছি, একজন খুনিকে আশ্রয় দেওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘন। তিনি এও বলেন, ‘আমি তার পরও তাকে অনুরোধ করেছি, আমাদের আইন এবং যেসব রুলস আছে, আমরা যদি সেগুলো এক্সামিন করি তাহলে কানাডা যাতে ফিরিয়ে দিতে পারে এমন কোনো পন্থা খুঁজে পাব আমরা।’ এটাও বলেছি, ‘তাকে ওখানে রাখাটা মানবাধিকার লঙ্ঘন।”
ঠিকানা/এনআই