১৮৮৫ সালে বিশ্ববিখ্যাত রাশিয়ান লেখক লিও টলস্টয় ‘মানুষ কেনো বেঁচে থাকে’-এই নামে একটি গল্প সংস্করণ প্রকাশ করেন। এই বইয়ের একটি গল্পের নাম- ‘তিনটি প্রশ্ন’। এটি একটি নীতিকথামূলক গল্প। প্রকাশিত হবার পর থেকে গত ১৩৫ বছর ধরে গল্পটি বহু ভাষায় অনুবাদিত হয়েছে। তারই কিছু লাইন উদ্ধৃত করছি।
‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হলো- বর্তমানে তুমি যাঁর সঙ্গে আছো। কেউই বলতে পারে না ভবিষ্যতে আমরা আবার তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবো কী না? সুতরাং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো- বর্তমানে তুমি যে মানুষের সাথে আছো- তাঁর ভালো করা। কারণ যে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে, তার একটাই কারণ- মানবকল্যাণ।’
এই মানবকল্যাণ বিষয়টি নিয়ে অনেক মূল্যবান কথাই বলা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে- If anything you want to be- then be kond.. অর্থাৎ মনুষ্যকূলে দয়ার ভান্ডারটি খুলে রাখতে হবে। প্রতিদিনের জীবন বিশ্বস্রষ্টাকে প্রতিদিন ডেকে বলি- ‘হে দয়াময়, দূর করে দাও সর্ব তুচ্ছ ভয়। বলি তোমার মহিমা দিয়ে, তোমার রহমত দিয়ে আমাদেরকে সুস্থ জীবন চলার তৌফিক দাও। তাহলে আমরাও অন্যের ভালো বা মঙ্গল বা কল্যাণ কামনায় নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখতে পারবো।’
মহান রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেন- ‘যদি তোমার কোনো কিছুর বিনিময়ে একটি শিশুর মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারো, তবে আমি আছি সেখানে তোমার পাশে।’
কিন্তু বাস্তবে আমরা সেটা কী করতে পেরেছি? সেইদিন ট্রেনে আগুন দিয়ে কতোগুলো জীবন অকালে ঝরে গেলো- সেটা কী নীতি সঙ্গত? বিবেকের কাছে প্রশ্ন করুন- যে শিশুটি সেইদিন ভস্মীভূত হলো- তারও তো বেঁচে থাকার অধিকার আছে। আর যদি সেই শিশুটিকে যারা অগ্নিসংযোগ করেছেন- তাদের কেউ যদি হতো সেই বিষয়টাকে সামাল দিতেন কীভাবে? তাইতো আঁতেল নয়- জ্ঞানী এবং বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরা সরব হয়ে বলেন- What it does take for an individual human being to be a good person?(অর্থাৎ, ভালো মানুষ হতে হলে আমাদের কী কী করা প্রয়োজন)। বলতে পারেন এটা রাজনীতির খেলা। কিন্তু এই খেলা তো যুদ্ধ নয়। এই খেলাতো হিংসা-বিদ্বেষ থেকে প্রসূত। রাজনীতির প্রথম কথাই হলোÑ জনগণের কল্যাণ। জনতার প্রতিনিধিরাই যদি ধ্বংসাত্মক পথটি বেছে নেন, তবে একটি জাতির কল্যাণ কী করে হবে? রাষ্ট্রের কল্যাণ কেমন করে হবে?
আসল বিষয়টি তো রাজনীতি নয়- বিষয়টি হচ্ছে ক্ষমতার লোভ। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না- ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু’। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে সিংহাসনের লোভে শেরশাহ ঝাঁপিয়ে পরেছিলেন সম্রাট হুমায়ুনের সুসজ্জিত মোগল বাহিনীর উপর। কিন্তু যুদ্ধজয় হয়নি, হয়েছে রক্তক্ষয়। শেরশাহ কাঁদলেন- ‘হারাই বুঝি বা দিল্লীর সিংহাসন, একমুঠো জোয়াড়ের লাগি।’ জোয়াড় মানে অন্ন। সিংহাসন অধিকার হলে সবকিছুই তো মহারাজার! যদিও শেরশাহ প্রবল বিক্রমে পরে সম্রাট হুমায়ুনকে সরিয়ে দিল্লীর মসনদে বসেছিলেন, কিন্তু তার স্থায়িত্ব ছিল কম।
আসল কথা হলো- দক্ষ নাবিক ছাড়া মহাতরঙ্গে জাহাজ ঠিক থাকবে কীভাবে? এই প্রশ্নটি বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে ঘুরে ঘুরে আসছে। নেতৃত্ব শূন্য বিরোধী দল (বিএনপি) গত ১৫টি বছর ধরেই সবকিছু বয়কট করে বসে আছেন। শুধু তাই নয়Ñ যে কয়টি ভালো কাজ হয়েছেÑ সেটাকেও সমর্থন দিতে তারা বিমুখ। ‘পদ্মাসেতু’র কথাই বলছি। তাদের কথামতো পদ্মাসেতু তো ভেঙে পড়ার কথা! কিন্তু এখনো তো সচল আছে। এই পথ দিয়ে কী বিরোধীদলের নেতৃবৃন্দ কিংবা অনুসারীবৃন্দ চলাচল করেন না, বাণিজ্য করেন না? নিশ্চয়ই করেন। সুতরাং একটিবার প্রশংসা করলে কী ক্ষতি হয়? বরং বিশ্বাস করি একটি ধন্যবাদ বার্তা- তাদেরকে যেমন জনতার কাছে নিয়ে যেতো, তেমনি সূধীমহলে প্রশংসিত হতো। এটাকে বলা হয়- পজিটিভ এবং নেগেটিভের খেলা। সবকিছুতেই যদি ‘না’ বলেন, তখন নেতিবাচক প্রভাব পড়ে জনগণের মনে। কিন্তু যতবেশি পজিটিভ থাকবেন, চিকিৎসা শাস্ত্রমতে দেহ-মন ততোবেশি উৎফুল্ল থাকবে। পূর্বতন বা বর্তমান সরকারের ভুলত্রুটিগুলো তখন আরো গুছিয়ে জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারবেন। এটাই তো নেতৃত্ব বা পরিচালকের কর্তব্য এবং বৈশিষ্ট্য। যখনি দিক্নির্দেশনায় ভুল সংকেত আসে- তখন সবই হয় বিশৃঙ্খল। বিপ্লব-বিদ্রোহ বা আন্দোলন যাই বলেন না কেনো- শৃঙ্খলা ছাড়া রাজনীতির জাহাজ বড় টলমলে। নেতৃত্বের এই দুর্বলতায় বিরোধীদল কৌশলের পথ ছেড়ে অগ্নিসংযোগ আর সন্ত্রাসের সুযোগ করে দিলেন।
এই বিকল্প প্রথা রাজনীতি তথা ভবিষ্যতের জন্য দুর্যোগময়। মনে রাখতে হবে- ‘যে ব্যক্তি মানুষের উপর দয়া করে নাÑ রাব্বুল আলামিন তাহার উপর দয়া করেন না।’
এবারে নির্বাচন বিষয়ে আসা যাক। ‘নির্বাচন বর্জন’ সত্যি কী স্বাস্থ্যপ্রদ হয়েছে? সাউথ এশিয়া ডেমোক্র্যাটিক সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক মি. পাউলো কাসাভো বলেন- ‘বিরোধীদলের নির্বাচন বয়কট মানেই নির্বাচনকে অবৈধ কিংবা অংশগ্রহণমূলক হয়নি, এমন বলা যায় না।’
মি. কাসাভোর মতো আরো একজন পর্যবেক্ষক মি. উইলিয়াম গেস্তার মতে- ‘আপনি যদি নির্বাচনকে হাতছাড়া করেন, তাহলে আপনি জনগণের কাছে যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করলেন। তাহলে আপনাকে রাজনীতিবিদ হিসেবে কে চিনবে? নির্বাচন হচ্ছে এমন এক সময়, যখন রাজনীতিবিদরা জনগণের কাছাকাছি আসেন।’
তাইতো অধিকার কর্মী খুশি কবীরের মতে, ‘ভোট বর্জন করে রাজনৈতিক দলগুলো ভুল করেছে।’
তাই একটা বিষয় থেকে যাচ্ছে- যদি এই ভুলগুলো আগামী পাঁচ বছরে শুধরানো না যায়, তবে রাজনৈতিক সংকট আরো বৃদ্ধিই পাবে।
এখানে একটু ‘চর্বিত চর্বণ’ প্রাসঙ্গিক মনে করি। মনে পড়ে আপনাদের ১৯৬৯-এর গণঅভুত্থানের কথা। তারপর ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়। এবং অবশেষে ১৯৭১-এর নির্বাচন। আইয়ুব-মোনেম-ইয়াহিয়া শাহীকে মেনে নিয়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। যদিও তাঁর আজীবন সংগ্রাম ছিল এই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। তিনি এবং তাঁর দল এবং সমর্থক গিয়েছেন প্রতিটি দুয়ারে দুয়ারে। এই গণসংযোগে ঢল নেমেছিল নির্বাচনে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগের জয় হলো। যদিও এর পরের দিনগুলো ছিল দুর্যোগময়। কিন্তু বিশ^বাসী এই নির্বাচনকে মেনে নিয়ে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন- যা মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল।
এতোক্ষণ তো শুধু সংকটের কথা বলা হলো। সমাধান কোথায়? বলা হয়েছে সংকটের মাঝ থেকেই সমাধানের সুযোগ রয়েছে। তার জন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিকে আরো সহনশীল এবং নমণীয় হতে হবে। একটুখানি মাথা নিচু করলে মাথা কাটা যায় না। এই মতবাদটিকে মাথায় রেখে নির্বাচন পর্যবেক্ষক মি. গেস্তা চমৎকার কয়েকটি কথা বলেছেন। তিনি বলেন- ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে তিক্ততা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক মেরুকরণ খুবই তিক্ত বিষয়। সবাইকে সমাধানের পথে আসতে হবে। ছাড় দেবার মানসিকতা রাখতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশ স্বাধীন করার পেছনে সবার অংশগ্রহণ ছিল, তাই আমি মনে করি, গণতান্ত্রিক পথে থাকতে সবাইকে অংশ নিতে হবে।’
আসলে আমরা আমজনতা দেশে শান্তি দেখতে চাই। দেখতে চাই সমৃদ্ধি এবং প্রবৃদ্ধি। এই সমৃদ্ধি হচ্ছে বলেই বড় বড় শক্তিগুলো বাংলাদেশকে পদানত করতে চাচ্ছে। সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্বের বুকে ১৯৭১-এ যেমন বুক চিবিয়ে দাঁড়িয়েছিÑ তেমনি থাকবো আজীবন- এই হোক ব্রত। এই মহূর্তে সমগ্র বিশ্বের সরকার ও প্রতিনিধিরা এই নির্বাচনকে সমর্থন দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি প্রয়োগের বদলে দুই দেশের জনগণের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরো গভীর করতে বাংলাদেশের সঙ্গে অঙ্গীকারের কতা পূণর্ব্যক্ত করেছেন। সুতরাং বিজয়ী যাঁরা হয়েছেন- তাদের মধ্যে আত্মপ্রসাদ বা আত্মতৃপ্তির জায়গা নেই। এগিয়ে যাবার আহ্বান রয়েছে। দুর্যোগ আছে এবং থাকবে। তেমনি থাকবে অরুণ আলোক। সুতরাং রাজনৈতিক রিফরমেশন হোক। অরুণ আলোকে অন্ধকার দূর হোক।



আমিনুর রশীদ পিন্টু


