মফিজুল হুসাইন
পৃথিবীর ইতিহাসে সরকার পরিবর্তন বা সামরিক অভ্যুত্থানে একটি পরিবারের এত লোককে নৃশংসভাবে হত্যার নজির বিরল, যা ঘটেছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে ঘিরে। সেই হত্যাকাণ্ড এতই হৃদয়বিদারক ও বিবেকবর্জিত যে তার পরিবারের সদস্য তো দূরের কথা, বাইরের কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। দেশের বাইরে থাকায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রাণে বেঁচে যান এবং পাহাড়সম শোক নিয়ে একজন একসময় রাজনীতিতে আসেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ শাসন করছেন। রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন যে তার পরিবারের হত্যাকাণ্ড শুধু কোনো দুজন মেজরের এক্সপিডিসন ছিল না, এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু পরিবারকে চিরতরে বিলীন করে দেওয়ার এক গভীর ষড়যন্ত্র ছিল। তিনি সে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার দৃঢ়প্রত্যয়ী হলেন আর তাতেই তৈরি হয়ে গেল এক বিভাজন রেখাÑআওয়ামী লীগ বনাম অ্যান্টি আওয়ামী লীগ।
পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ড : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার ভোররাতে বেঙ্গল লেন্সারের মেজর ফারুকুর রহমান এবং দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির মেজর আব্দুর রশীদের নেতৃত্বে, যারা উভয়ে ভায়রা ভাই, ৪০০ সৈনিক সামরিক অভ্যুত্থান শুরু করে। তাদের সঙ্গে আরও যোগ দেয় মেজর মহিউদ্দিন, মেজর হুদা ও মেজর পাশা। রিং লিডার মেজর ফারুক সামরিক বাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর ডালিম, মেজর নুর ও মেজর শাহরিয়ারকেও এই অভিযানে যুক্ত করে নেয়। শেষোক্ত এই তিনজন কোনো এক সামাজিক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর পুত্র কামাল ও তৎকালীন রেডক্রসের চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফার পুত্রের সঙ্গে এক অপ্রীতিকর ঘটনায় জড়িয়ে গেলে বঙ্গবন্ধু তাদেরকে সামরিক বাহিনী থেকে বহিষ্কার করেন। ১৫ আগস্ট রাত ১২টায় সবাই একত্রিত হলে ফারুক সবাইকে তার পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করে জানতে চায় কারও কোনো আপত্তি আছে কি না। সবাই সম্মতিসূচক জবাব দিলে ফারক ঢাকা শহরের একটি ট্যুরিস্ট ম্যাপ দেখিয়ে উপস্থিত সকল বাহিনীকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করে দেয়।
মেজর ডালিমকে প্রধান টার্গেট বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অভিযানের নেতৃত্ব দিতে বললে সে অস্বীকার করে, তার পরিবর্তে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ি আক্রমণ করার দায়িত্ব নেয়। মেজর মহিউদ্দিন ও মেজর নুরকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং ফারুকের খুবই বিশ্বস্ত এনসিও রিসালদার মোসলেউদ্দিনকে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণির বাসা আক্রমণের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। একটি ট্যাংকসহ একদল সৈন্য এয়ারপোর্টে পাঠানো হয় রানওয়ে কন্ট্রোল করার জন্য, যদি না ভারত রিঅ্যাক্ট করে সৈন্য পাঠাতে এয়ারপোর্ট ব্যবহার করে। একদল পাঠানো হয় রেডিও স্টেশনে, এক গ্রুপ পাঠানো হয় তৎকালীন বিডিআরের পিলখানায়, যদি না তারা প্রতিহত করতে আসে। ফারুক নিজে দায়িত্ব নেয় রক্ষীবাহিনী সামাল দেওয়ার, যদি তারা ব্যারাক থেকে বের হয়ে আসে। রশীদের দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক, সে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগ নেতা মোশতাককে এনে রাষ্ট্রপতির পদে বসানো, হত্যার সংবাদ প্রচার করা এবং অভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে সামরিক কমান্ডের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করা। ভোর ৫টা ১৫ মিনিটে মহিউদ্দিন ও নুরের দল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে এলে পাহারারত পুলিশের সঙ্গে কিছুক্ষণ গোলাগুলি হয়। এতে অভ্যুত্থানকারীদের একজন সৈন্য নিহত ও আরেকজন গুরুতর আহত হলে সৈন্যরা প্রচণ্ড গোলাগুলির মাধ্যমে পুলিশদের পরাভূত করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢুকে পড়ে। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফারুকের বেঙ্গল ল্যান্সারের কিছু সৈন্য আগে থেকেই পাহারারত ছিল, কিন্তু কালো পোশাকে তাদের সহকর্মীদের দেখে তারা কোনো বাধা দেয়নি।
দোতলায় বঙ্গবন্ধু-পুত্র শেখ কামাল, জামাল স্টেনগানের সাহায্যে কিছুক্ষণ প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বিশাল সামরিক অস্ত্রের কাছে তারা হার মানতে বাধ্য হন। তার বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে ফোন করেন কিন্তু উচ্চ পর্যায়ের কোনো অফিসারকে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফোন রেখে দিয়ে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে ফোনে পেয়ে দ্রুত সামরিক সহায়তা চান। সফিউল্লাহ জানান, তিনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন। শেখ জামাল তার স্ত্রী, ভাবি ও অন্যদের একটি রুমে ঢুকিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন।
১০ বছরের শেখ রাসেল একটি সোফার নিচে লুকিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। ঘাতকেরা নিচতলা পরিষ্কার করে ওপরে ওঠার চেষ্টা করে। সিঁড়ির কাছেই পাইপ হাতে সাদা পোশাক পরা বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি হয় মেজর মহিউদ্দিন। বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্বের কাছে মহিউদ্দিন অসহায় হয়ে পড়ে বলে, ‘স্যার, আপনি আসুন।’ বঙ্গবন্ধু কর্কশ গলায় জানতে চান, তারা কী চায় এবং আরও বলেন, পাকিস্তানিরাই তাকে মারতে পারেনি তোরা কী করে মারবি। এমন সময় মেজর নুর সেখানে এসে দেখে মহিউদ্দিন সময় নষ্ট করছে আর তখনই সে বুলেটের গুলিতে বঙ্গবন্ধুর বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। আর ৫টা ৪০ মিনিটে অবসান হয় সে মানুষটির সঙ্গে বাংলার ৬০ বছরের গভীর প্রেম (একজন লেখকের উক্তি)। তারপর তারা প্রতিটি রুমে ঢুকে যাকে পেয়েছে পাশবিকভাবে নির্বিচারে হত্যা করেছে। বেগম মুজিব, শেখ কামালের গর্ভবতী স্ত্রী এমনকি ১০ বছরের শেখ রাসেলসহ কাউকেই রেহাই দেয়নি। অপর গ্রুপ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ি ও শেখ মণির বাড়িতে একই হত্যাকাণ্ড ঘটায়, যা বাংলার ইতিহাসে এক জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইল।
ঢাকায় অবস্থানরত উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাগণ : সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ এই অভ্যুত্থান সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকারে ছিলেন। তবে ডেপুটি সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ এবং শাফায়েত জামিল একটা পরিবর্তনের ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সম্পর্কে রিং লিডার ফারুকের মামা হন এবং তারা প্রায়ই দেশের আর্তসামাজিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। ফারুক খুবই আত্মপ্রত্যয়ী ছিল যে খালেদ মোশাররফ তার বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশনে যাবেন না। রশীদ জিয়াউর রহমানের কাছে দেশের পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করে এবং একপর্যায়ে তাকে নেতৃত্বদানের অনুরোধ করে। জিয়া তা অস্বীকার করেন এবং একপর্যায়ে তার সেক্রেটারিকে নির্দেশ দেন, রশীদ যেন তার কাছে আর না আসতে পারে। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যান্টনমেন্টে রটে যায় একটি সামরিক অভ্যুত্থান অত্যাসন্ন এবং রশীদ-ফারুক এর হোতা। এটা শুনে ব্রিগেডিয়ার শাফায়েত জামিল তার অধীন রশীদকে ডেকে এনে জানতে চান কী হচ্ছে। রশীদ সরাসরি অস্বীকার না করে বলে, যদি তার কোনো বিপদ হয়, তাহলে সে শাফায়েত জামিলকে জড়াবে এবং বলবে, সে যা কিছু করেছে শাফায়েত জামিলের নির্দেশেই করেছে। জামিল আর কোনো কথা বাড়াননি। তবে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের কী ভূমিকা বা কেনই-বা তারা কোনো কিছু জানতে পারল না বা ইচ্ছাকৃতভাবেই কি দায়িত্ব এড়িয়ে গেল, তা আজও রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। রাত ১০টায় তাদের হেডকোয়ার্টারের সামনে দিয়ে ক্যুনেতা ফারুক ২৮টি ট্যাংকবহর নিয়ে চলে গেল, ডিজিএফআইয়ের কেউ কিছু জানল না, অথচ তাদের ২৪/৭ কাজ করার কথা।
বিদেশি কানেকশন : এই অভ্যুত্থানে বিদেশি কানেকশনের কোনো প্রমাণ না থাকলেও অনেকেই আমেরিকার দিকে ইঙ্গিত করেন। তেমনি একজন ‘বাংলাদেশ, দ্য আনফিনিশড রিভলিউশন’ বইয়ের লেখক লরেন্স লিফসুল্জ ১৯৭৯ সালের ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু হত্যার চার বছর পর, লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় লেখেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার এক বছর আগে থাকতেই মোশতাক গং ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করে বোঝার চেষ্টা করে বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দিলে আমেরিকার মনোভাব কী হবে। তিনি আরও লেখেন, ঢাকা দূতাবাসের বিশ্বস্ত সূত্র তাকে বলেছে, তার এ বিষয়ে অনেকের সঙ্গেই কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু তিনি তার সূত্রের নাম বা কারা যোগাযোগ করেছে, তার কিছুই উল্লেখ করেননি। মেজর ফারক অপর একজন বিখ্যাত ‘বাংলাদেশ, এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ বইটির লেখক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিল, ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের রাতে আমেরিকার দূতাবাসের কয়েকটি গাড়ি রাস্তায় হংকিং করতে দেখে সে একটু অবাকই হয়েছে। যদিও কোনো সূত্রই দাবি করেনি মেজরদ্বয় কখনো আমেরিকান দূতাবাসে যোগাযোগ করেছিল। তবে অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসকে বাংলাদেশ মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স সূত্রে জানানো হয়, জেনারেল জিয়ার পক্ষ থেকে আমেরিকান দূতাবাসে যোগাযোগ করা হয় এবং তিনি পোস্ট মুজিব পদে আগ্রহী কিন্তু সরাসরি কোনো ভূমিকা নিতে আগ্রহী ছিলেন না। ম্যাসকারেনহাসও তার সূত্রের নাম বলেননি।
রাজনৈতিক কানেকশন : মেজর গং আওয়ামী লীগের অনেক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। মোশতাকের সঙ্গে রশীদের একাধিক বৈঠক হয়েছে। সব বৈঠকই হয়েছে মোশতাকের আগামসি লেনের বাসায়। মোশতাকের দোসর তাহেরউদ্দিন ঠাকুর দাবি করেছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দুই দিন আগে অর্থাৎ ১৩ আগস্ট তার বাসায় বঙ্গবন্ধু হত্যার রূপরেখা চূড়ান্ত হয়, যদিও মেজরদ্বয় কসম খেয়ে বলেছে, তারা কখনো ঠাকুরের বাসায় যায়নি। মেজর ডালিম একাধিকবার মন্ত্রী এইচ এম কামরুজ্জামান হেনার সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্ষমতা নিতে অনুরোধ করেছিল কিন্তু হেনা রাজি হননি। ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামকেও কোনো একজন ক্ষমতা নিতে অনুরোধ করেছিল কিন্তু তিনি পাত্তা দেননি, তবে তিনি বাকশাল করাতে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
বিভাজন : বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সমগ্র পরিবারকে হারিয়ে রাজনীতিতে এসে দেখলেন, ওই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বরং ওই খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। কাউকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল গঠন করতে দিয়ে সংসদে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু-কন্যা কষ্ট পেলেও ধৈর্য হারাননি। দলকে একটা ধ্বংসস্তূপ থেকে এনে দাঁড় করিয়ে নিলেন। ওই খুনিদের বিচারে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন। একটি অনৈতিক রাজনৈতিক পরিবেশে তিনি নিজে নৈতিকতা বজায় রাখলে কিছুই করতে পারবেন নাÑএ সত্যটা তিনি উপলব্ধি করলেন। মাঝেমধ্যে তিনি অনৈতিক হলেন এবং ফলও পেলেন। হাতের মুঠোয় পাওয়া খুনিদের বিচারের আওতায় আনলেন আর বিদেশে পালিয়ে থাকাদের ফিরিয়ে আনার নিরন্তর চেষ্টা করতে লাগলেন, যা সহজসাধ্য নয় কিন্তু চেষ্টা অব্যাহত রাখলেন। এতে আওয়ামী লীগ বনাম অ্যান্টি আওয়ামী লীগ বিভাজন রেখাটা আরও প্রকট হলো।
সূত্র : এ লিগ্যাসি অব ব্লাডÑঅ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস, ফ্যাক্টস অ্যান্ড ডকুমেন্টসÑঅধ্যাপক আবু সাইদ, বাংলাদেশ : এক রক্তাক্ত অধ্যায়Ñব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন
-নিউইয়র্ক