জুলাই বিপ্লব নিয়ে আলোচনা করতে হলে চোখের সামনে ভেসে আসে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জুলাই মাসের বিপ্লবের চিত্রসমূহ। ১৯২৫ সালের জুলাই মাসে ইকুয়েডরে সংঘটিত হয় সৈনিক-জনতার বিপ্লব।
১৮৩০ সালের ফরাসি বিপ্লব ফ্রান্সের গণবিপ্লবের এমন এক চিত্র, যা ১৮৩০ সালের ২৬ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
জুলাই বিপ্লবের সর্বাত্মক গণবিদ্রোহের ইতিহাস (১৮৩০), বিদ্রোহ, যা সংঘটিত হওয়ার পর ‘লুই-ফিলিপ’ ফ্রান্সের সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১৮১৪ সালের জুলাই সনদের পরিপন্থী বিধিনিষেধমূলক অধ্যাদেশ প্রকাশ করার পরই সে দেশের মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে এবং গণবিপ্লবের সূত্রপাত হয়। রাজপথে প্রতিবাদী জনতার প্রচণ্ড গণবিক্ষোভের পর তিন দিনের লড়াই (২৭-২৯ জুলাই), এর ব্যাপক গণরোষের মুখোমুখি হয়ে চার্লস দশম পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
একই বছরের ২ আগস্ট লুই-ফিলিপকে ‘ফরাসিদের রাজা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় (৯ আগস্ট)।
জুলাই বিপ্লবে উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণি একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক আধিপত্য অর্জন করে, যা জুলাই রাজতন্ত্র (১৮৩০-৪৮) নামে পরিচিত সময়কালকে চিহ্নিত করা হয়।
ঐতিহাসিকদের মতে, ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লব (১৮৩০) ছিল একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন, যা রাজতান্ত্রিক নিপীড়ন ও গণঅসন্তোষ থেকে জন্ম নিয়েছিল। এই বিপ্লবের পটভূমি বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে।
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পতনের পর ইউরোপের রাজতন্ত্রপন্থী শক্তিগুলো লুই অষ্টাদশকে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসায়। যদিও তিনি একটি সংবিধান ১৮১৪ এর সনদ মেনে দেশ শাসন করেন এবং তাতে রাজা ও অভিজাতদের ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত বেশি।
লুই অষ্টাদশের মৃত্যুর পর তার ভাই চার্লস দশম (১৮২৪-১৮৩০) ক্ষমতায় আসেন। তিনি ছিলেন চরম রক্ষণশীল ও রাজতন্ত্রবাদী। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি কট্টর ধর্মীয় গোষ্ঠী তথা গির্জার ফলোয়ার এবং অভিজাত শ্রেণিকে অধিক প্রাধান্য দিতে শুরু করেন। সংবিধান পরিবর্তন করে গণমানুষের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ শুরু করেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়, যার ফলে জনগণের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। নাগরিকদের ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আরোপ করেন। এর মাধ্যমে জনগণকে তাদের নিজস্ব পছন্দের প্রার্থীকে ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত করা হয়।
১৯৬৮ সালের ১৭ জুলাই বিপ্লবে ইরাকে সংঘটিত হয় একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান। জেনারেল আহমেদ হাসান আল বকর এর নেতৃত্ব দেন। সেই অভ্যুত্থানের আরেক অংশীজন ছিলেন সাদ্দাম হোসেন এবং সালাহ ওমর আল আলী। পরবর্তী সময়ে সাদ্দাম হোসেন পরিচালিত আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়।
ইতিহাসবিদ চার্লস আর এইচ ট্রিপের মতে, ‘ইরাকের সেই অভ্যুত্থান মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তাপুষ্ট রাষ্ট্রসমূহের নিরাপত্তাব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল।’ ফলে তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা সাদ্দামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির অনুসারী সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরব রাষ্ট্র সাদ্দাম হোসেনকে সমর্থন জানায়নি।
অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসনে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে সেপ্টেম্বর ইলেভেনের ঘটনার পর পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ করার কল্পিত কাহিনি সাজিয়ে ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের যৌথ বাহিনী আক্রমণ করে। সেই হামলার মধ্য দিয়ে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের বাথ পার্টি ক্ষমতাচ্যুত হয়। ১৭ জুলাই বিপ্লব থেকে গড়ে ওঠা ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের একনায়কতান্ত্রিক দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটে। অতঃপর ইরাককে যুক্তরাষ্ট্র বহুজাতিক জোট বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। মধ্যপ্রাচ্যের একসময়কার সবচেয়ে তেলসমৃদ্ধ অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ ইরাক অর্থনৈতিক মন্দা এবং চরম মানবিক সংকটে নিমজ্জিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর নীতির বিরুদ্ধে থাকলে কী পরিণতি হয় (?), তা ইরাক, ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরান ও লিবিয়াকে কড়ায়গন্ডায় মাশুল দিতে হয়েছে।
সাদ্দামের পতনের মধ্য দিয়ে একসময়কার মধ্যপ্রাচ্যের ইসরায়েলি আতঙ্কের প্রতাপশালী দেশ ইরাককে একটি দুর্বল ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। প্রথমে ইরাকের ওপর আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও নানা ধরনের হুমকি প্রদান করা হয়। পরে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন যৌথভাবে ইরাকের ওপর হামলা শুরু করে। হাজার হাজার সেনাকর্মী ও সাধারণ মানুষের রক্তের ওপর দিয়ে শেষ পর্যন্ত ইরাকে সাদ্দাম হোসেন সরকারের পতন হয়।
২০১১ সালের মিসরের বিপ্লব শেষ পর্যন্ত আরব বসন্তের বিপ্লবে রূপ লাভ করেছে। তিউনিসের আরব বসন্তের সেই পরিস্থিতির জেরে তিউনিসিয়া হয়ে মিসরে একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে ইয়েমেন, জর্ডান, আলজেরিয়া, ইরাক কিংবা লিবিয়া ও সিরিয়ায়। কায়রোর ঐতিহাসিক তাহরির স্কয়ারের লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ থেকে আশা করা হয়েছিল, আরব বিশ্বের জন্য এই বিপ্লব দুনিয়ার অনেক কিছুকেই পাল্টে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে যদি মিসরের বিপ্লবীরা সফল হয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে মিসরের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে অন্যান্য স্থানে শুরু হওয়া সুপ্ত বিপ্লবও সাফল্য লাভ করবে। মিসরের তাহরির স্কয়ার থেকে চূড়ান্ত পর্যায়ে শুরু হওয়া স্বতঃস্ফূর্ত মিলিয়ন মানুষের গণবিক্ষোভ রাতের আঁধারে হাইজ্যাক না হলে কিংবা মিসরের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি যদি টিকে যেতেন, আরব বিশ্বের চেহারা পাল্টে যেত। বিপ্লবের সফলতার সূচনায় মনে হচ্ছিল, সপ্তাহান্তের যেকোনো দিনের মতোই আবর বিশ্বের ভোরের আকাশ নতুন এক আলোর আভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। দীর্ঘদিন থেকে অবহেলিত জনপদ ফিরে পাবে তাদের মুক্তি, স্বাধীনতা এবং ন্যায্য অধিকার। প্রত্যাশা ছিল, ফিলিস্তিনসহ অন্যান্য আরব দেশের অবহেলিত পরাধীন জনগোষ্ঠীর পূর্ণ অধিকার ও স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার পথ সুগম হবে। মোহাম্মদ মুরসির সেই সব ন্যায্য দাবি পূরণ করার চেষ্টায় আরব দেশসমূহের দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসান হবে। বহুকাল যাবৎ কোণঠাসা আরব্য জনপদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, স্বকীয়তা ও প্রকৃত স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার দ্বার উন্মুক্ত হবে। সেই প্রত্যাশা যুগ যুগ ধরে।
পৃথিবীর পরাশক্তিদের সমর্থনপুষ্ট স্বৈরশাসকদের নির্যাতনে কোণঠাসা হয়ে পড়া মিসরের জনগণ তখন রাজপথকেই নিজেদের ঘরের চেয়ে নিরাপদ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তখনকার মতো এমন স্বতঃস্ফূর্ত জনস্রোত এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিবাদী জনতার চোখেমুখে স্বাধীনতার স্বপ্ন উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এক বছরের মাথায় আরবের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ষড়যন্ত্রের মুখে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মদদপুষ্ট সেনাপ্রধান ক্ষমতা দখল করেন। মুসলিম ব্রাদারহুড নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে ধ্বংস করে মিসরে আবারও সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এভাবেই গণমিসরের বিপ্লবকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
বিপ্লব হচ্ছে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিলোপ সাধন করে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মৌলিক ও সামাজিক পরিবর্তন, যা তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কিংবা তারও বেশি সময়ের ব্যবধানে সংঘটিত হয়ে থাকে।
এ ধরনের বিপ্লব তখনই প্রয়োজন হয়, যখন দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাষ্ট্রীয় অনাচার, স্বেচ্ছাচারিতা, শোষণমূলক নির্যাতন, নিপীড়ন ও অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায়। মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা থাকে না। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সামাজিক পরিবেশ বিনষ্ট হয়। তখন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য গণমানুষের সর্বাত্মক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। দেশের নাগরিকদের অধিকার হরণ করার মধ্য দিয়ে যদি রাষ্ট্রের শাসক ও ক্ষমতাসীন দলের অত্যাচার, নির্যাতন ও দমন-পীড়নের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন একটি গণবিপ্লব জরুরি হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের বেলায়ও সে রকম ঘটনার অবতারণা হয়। দেশের সর্বত্র রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দমন-পীড়ন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় ক্যাডারদের দ্বারা হামলা চালানো হয়। সরকার ও প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে মসজিদের ইমাম পর্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। জনগণের ওপর অমানবিক অত্যাচার, শোষণ, নিপীড়ন ও নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফলে সমাজের সর্বস্তরে গণমানুষের সংক্ষুব্ধতা, প্রতিবাদ সোচ্চার হয় এবং গণরোষ দানা বেঁধে ওঠে। যখন রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে দমন-পীড়ন, গুম-খুন, অত্যাচার, গণহত্যা ও গণনির্যাতনের মাত্রা সকল সীমা অতিক্রম করে; তখন চলমান ফ্যাসিজম ও স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা, অপশাসন এবং সরকার-নিয়ন্ত্রিত কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ, অসন্তোষ ও প্রতিবাদী চেতনা সোচ্চার হয়ে ওঠে।
বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের মৌলিক ও র্যাডিক্যাল পরিবর্তন আসে। এ ধরনের বিপ্লবের সঙ্গে অনেক সময় সহিংসতা ও রক্তপাত জড়িত থাকে এবং দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। আসলে মানুষ নিজের কর্মের মাধ্যমেই তার ভালো-মন্দের ফলাফল পেয়ে থাকে। গণমানুষের সর্বাত্মক প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও জাগরণের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে সেটি কোনো রাজনৈতিক বিপ্লবের মাধ্যমে ঘটেনি। দেশের ছাত্র-শিক্ষক, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণের ফলে বিপ্লব সফল হয়েছে। যখন ব্যাপক সহিংসতা, ধ্বংসাত্মক রক্তপাত, গণহত্যার বীভৎসতা সমস্ত মানবিক কাঠামোকে ধ্বংস করে দেয়; তখনই সরকার পতনের আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে।
২০২৪-এর ৫ আগস্ট কিংবা ৩৬ জুলাই বাংলাদেশের এই সফল বিপ্লব বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এটি এমন একটি গণবিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থান, যা প্রথমে কোনো সরকার পতনের আন্দোলন ছিল না। সরকারের প্রতিটি সেক্টরের লাগামহীন দুর্নীতি, ব্যাংক-বিমা ও রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ভারে বৈদেশিক ঋণের বোঝায় চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়, বিরোধী মতের লোকদের দমন-পীড়নে নিষ্ঠুরতম পন্থা অবলম্বন, গুম-খুন-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ নানা রকম অপরাধমূলক কার্যক্রম ও সহিংসতায় চরম অস্থিরতা বিরাজ এবং সরকারপ্রধানের অহংকার, প্রতিহিংসাপরায়ণতার দম্ভ-দাম্ভিকতায় নিজেই তার পতন ডেকে আনে। প্রথম থেকেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং তার সরকারের তরফ থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বরং ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে নানা রকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়েছে। সরকার ছাত্রদের এই যৌক্তিক আন্দোলনের প্রতি সামান্যতম সমর্থন ও সমবেদনা প্রদর্শন না করায় সেটি ধীরে ধীরে তীব্র আন্দোলনে রূপ নেয়।
সেই ২০১৮ সালের পর থেকে ছাত্রদের প্রতি ক্রমাগত অবহেলা প্রদর্শন এবং বৈষম্যমূলক আচরণ করা শুরু হয়। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় সেটি তীব্র আন্দোলনের দিকে মোড় নেয়। তখন থেকেই ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবের রক্তাক্ত অধ্যায়ের চূড়ান্ত পরিণতিতে সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয় এবং ছাত্র-জনতার বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ‘বাংলা ব্লকেড’ শব্দটির সঙ্গে জনমনের একাত্মতা ছিল একটি নতুন সংযোজন। স্বৈরাচারী সরকারের দমননীতির প্রয়াসে আশ্রয় নিয়েছিল একাত্তর-পরবর্তী ঘৃণ্য ‘রাজাকার’ শব্দের মধ্যে। কোটা সংস্কারের ন্যায্য দাবিকে পাশ কাটিয়ে সরকারপ্রধান ও তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের অগণতান্ত্রিক বিদ্বেষী আচরণ, ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কে কটূক্তি, রাজাকারের বাচ্চা হিসেবে আপত্তিকর ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা, ছাত্রদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিনের চেপে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। একপর্যায়ে অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাঠামো চুরমার হয়ে যায়। স্বৈরশাসনের অবসানের পর জুলাই বিপ্লব সফল হয়। বিস্ময়করভাবে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বাংলাদেশ একটি নতুন যুগের সূচনা করে।
একটি দেশের রাজনৈতিক শিষ্টাচার-বহির্ভূত কার্যকলাপ, সাংবিধানিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও অধঃপতিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির চূড়ান্ত বিপর্যয়ের পর ছাত্র-জনতার আন্দোলন একটি গণবিক্ষোভ, গণজাগরণে রূপান্তরিত হয়। কীভাবে সমগ্র জাতিকে একটি প্ল্যাটফর্মে জড়ো করে ঐক্যবদ্ধভাবে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়, বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব তার শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকারি বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়ন ব্যতীত বাংলাদেশে তো সে ধরনের রক্তপাত ঘটেনি। জুলাই বিপ্লবের প্রথম থেকেই আন্দোলনকারীরা ছিল নিরস্ত্র এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবেই এগোতে থাকে। তারা কখনো কোনো সহিংস পথে পা দেয়নি। তাদের দাবিদাওয়া আদায়ের জন্যই আন্দোলনে তারা সক্রিয় ছিল।
পরবর্তী সময়ে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলনের জের হিসেবে গণঅভ্যুত্থান ও গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের চেপে থাকা বাংলাদেশের বিগত শক্তিধর শাসকের নিদারুণ পরাজয় ঘটে। জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে প্রতিদিনকার পরিস্থিতির পটপরিবর্তনে লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতার গণজোয়ারে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সাম্প্রতিক কালে তো নয়ই, এ ধরনের ঘটনা ইতিহাসে বিরল।
বাংলাদেশে কীভাবে এত দ্রুত একটি সফল বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, তা নিয়ে বিস্তর সংশয় ছিল। আসলে ইতিহাসের শক্তি এমনই। আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না। যেমনি বাংলাদেশেও শেখ হাসিনা সরকার শিক্ষা নেয়নি। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, ২০০৮ সালে সরকার গঠন করার পর আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য নানা রকম অপকৌশলের আশ্রয় নেয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তারা ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক সরকার পরিচালনার পথ থেকে দূরে সরে যায়। জাতীয় জীবনের দুর্ভাগ্য যে, শেখ হাসিনা দেশের শাসনভার গ্রহণের পর আস্তে আস্তে জনগণের ভালোবাসা থেকে দূরে সরে যান। তিনি সকল গণতান্ত্রিক রীতিনীতি পরিহার করে কীভাবে যেন একনায়কতন্ত্রী ও স্বৈরতন্ত্রী হয়ে উঠলেন। তার সময়ে যেমন দেশের উন্নয়ন হয়েছে, তেমনি দুর্নীতির মহোৎসবে উপর মহল থেকে তৃণমূল পর্যন্ত গোটা দেশে চরম বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় নেমে এসেছে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের অতীতের অন্যান্য সরকারের সময়েও জনগণের বেহাল অবস্থা ও দুর্গতির কমতি ছিল না।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদ্ধতিকে বাতিল করে দিয়ে শেখ হাসিনা নিজের খেয়াল-খুশিমতো সরকার গঠন, পরিবর্তন ও পরিচালনা করতে থাকেন। বছরের পর বছর রাষ্ট্রক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। সর্বস্তরের মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন এবং লাগামহীন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে গোটা দেশ। একজন সরকারপ্রধান যখন গর্বের সঙ্গে বলতে পারেন, তার পিয়নও ৪০০ কোটি টাকার মালিক, যে হেলিকপ্টারে আসা-যাওয়া করে! তখন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নিজেকে সবার ঊর্ধ্বে, সর্বোচ্চ ভাবতে শুরু করেন। সরকারপ্রধান নিজেই সকল প্রকার জবাবদিহির ঊর্ধ্বে চলে যান, সমগ্র দেশে একনায়কতন্ত্র কায়েম করার মধ্য দিয়ে নিজেই একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন। তিনি তখন তার দলীয় রাজনীতিতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার ব্যবস্থা করে দেন। দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এবং সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং ভিন্নমতের মানুষের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, অবজ্ঞা ও অবহেলা প্রদর্শন করা হয়। সমগ্র দেশে গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নজিরবিহীনভাবে সংঘটিত হতে থাকে। ক্ষমতার দাপটে দম্ভ-দাম্ভিকতার মাধ্যমে একটি জাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসে।
জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর সরকারের দমন-পীড়ন শুরু করার মধ্য দিয়ে সরকার নিজেই তার বিপদ ডেকে আনে। প্রথমে কোটা সংস্কার আন্দোলন পরবর্তীতে সেটি অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারি দলের (ছাত্রলীগের) ক্যাডারদের নির্যাতন ও নিপীড়নের মাত্রা চরম আকার ধারণ করে। বিগত ১৫ বছরে ছাত্রলীগের অপরাধের মাত্রা বেড়ে এতটাই ভয়ংকর হয়ে উঠেছে যে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগের কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকেনি। সবকিছুকে ম্লান করে দিয়ে নিরস্ত্র ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর বর্বরোচিত হামলা শুরু করে। তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ হাসপাতাল পর্যন্ত গড়িয়েছে। শত শত আহত ছাত্রছাত্রীর ওপর সরকারদলীয় ক্যাডার এবং পুলিশ বাহিনী নিষ্ঠুরতম কায়দায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে ছাত্র-জনতার ওপর পৈশাচিক হামলায় সারা দেশ ও বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছে। এভাবেই সরকারের পায়ের নিচের মাটি সরে যেতে শুরু করে।
১৬ জুলাই-২০২৪ সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদকে আন্দোলনরত অবস্থায় প্রকাশ্যে পুলিশ গুলি করে হত্যা করার পর সমগ্র বাংলাদেশে আন্দোলন বারুদের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আন্দোলন দমনে মরিয়া হয়ে উঠেছিল শেখ হাসিনার সরকার। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সরকার রাজাকার হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং তাদের নির্মূল করার জন্য সরাসরি রাষ্ট্রপ্রধান এবং মন্ত্রিসভার নির্দেশ দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের সরাসরি গুলি এবং বিশেষ মারাত্মক মারণাস্ত্র প্রয়োগের হুকুম দেওয়া হয়। একইভাবে কয়েকটি মিডিয়ার টকশোতে ও সরকারের সমর্থকদের কোনো সুবিধাভোগী উসকানিমূলক বক্তব্য দিতে থাকে। একজন বিতর্কিত বিচারপতি তো টকশোতে আন্দোলনরত সবাইকে রাজাকার বলে গালিগালাজ করে। রাজাকারদের সংখ্যা ৪ কোটি উল্লেখ করেন এবং প্রয়োজনে তাদের সবাইকে হত্যা করার যুক্তি দেখিয়ে আপত্তিকর অনবরত বক্তব্য দিয়ে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তোলে। তার পর থেকে সারা দেশের ছাত্রছাত্রীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সমস্ত দেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ছাত্রছাত্রীদের থালা-বাটি ও কন্টেইনারে বাদ্যযন্ত্রের হুংকার ও নতুন নতুন স্লোগান হাজার হাজার তরুণ ছাত্রছাত্রী সুর মিলিয়ে ক্যাম্পাসে-রাজপথে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তাদের স্লোগানে আরও একটি নতুন শব্দ যোগ হয় : ‘তুমি কে আমি কে-রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছেÑস্বৈরাচার স্বৈরাচার’ ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ কিংবা জুলাই বিপ্লবে নারীদের অবিস্মরণীয় অবদানের কথা ভুলবার নয়। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসার পর পৃথিবীর বুকে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাসের জন্ম দেয়। কী অদম্য সাহস! পুলিশের গুলির সম্মুখীন হয়ে কোনো রকমের ভয়ভীতি তাদেরকে দমাতে পারেনি। জুলাই বিপ্লবে আত্মোৎসর্গকারী ১১ নারীর অবদান চিরস্মরণীয় ও অম্লান হয়ে থাকবে।
স্কুলের দুঃসাহসী ছাত্রীর কণ্ঠে আজও ভেসে উঠছে, ‘বাবাকে বলে এসেছি, আন্দোলনে যদি মারা যাই, বিজয়ের আগে যেন আমার লাশ দাফন করা না হয়।’ যে দেশে ছাত্রীরা এমন আগুনঝরা অভিব্যক্তি করতে পারে, সে দেশের বিপ্লব সফল হতে বাধ্য। যেখানে নারীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্র হয়ে রুখে দাঁড়ায়, সেখানে কোনো স্বৈরশাসক টিকে থাকতে পারে না। কী আশ্চর্য উচ্চারণ! অদম্য সাহস! ওদের চোখেমুখে সামান্যতম ভয় নেই।
স্যালুট, আমাদের সাহসী সন্তান... যারা মানুষের মুক্তি, স্বাধীনতা ও অধিকার আদায় করতে রাজপথে জীবনবাজি আন্দোলনে উচ্চারণ করে :
‘কথায় কথায় বাংলা ছাড়
বাংলা কি তোর বাপ-দাদার।’
‘কে এসেছে কে এসেছে
পুলিশ এসেছে পুলিশ এসেছে
কী করছে কী করছে
স্বৈরাচারের পা চাটছে।’
‘পেছনে পুলিশ, সামনে স্বাধীনতা’ ইত্যাদি এমন অনেক ধরনের নতুন নতুন সেøাগান আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। প্রতিদিন বৈচিত্র্যময় সংগ্রামী পথযাত্রা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ক্ষিপ্রতর করে তোলে।
স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কী আর্শ্চয জাগরণ (!), উত্তাল সমগ্র দেশে গণজোয়ার সৃষ্টি করে। কী অদ্ভুত পরিবর্তন। আশ্চর্য সম্মোহন :
‘যদি তুমি হোঁচট খাও, যদি তুমি ভয় পাও, পিছনে পুলিশ,
যদি তুমি এগিয়ে যাও, সম্মুখে বাংলাদেশ।’
‘যদি ভয় পাও, তবেই তুমি শেষ
যদি সামনে এগিয়ে যাও, তবেই বাংলাদেশ।’
‘যদি ভয় পাও, তাহলে তুমি শেষ
যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তবেই বাংলাদেশ ॥’
আন্দোলন ক্ষিপ্রতর করতে স্লোগানের নতুন ভাষা সমস্ত পরিবর্তনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
‘একটা মেধা পড়লে দশটা কোটা গিলে খাব। গিলে খাব মানে গিলে খাব।’
‘দেশ আমাদের মা, কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে দেশ আমাদের সন্তান হয়ে যায়। সরকার যেভাবে বাচ্চাদের পাখির মতো গুলি করে মেরেছে, ঈশ্বরও ঠিক থাকতে পারে না।’
কী আশ্চর্য জাগরণ! আশ্চর্য শব্দ ঝংকার। শাবাশ বাংলাদেশ।
১৬ জুলাই স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশি বুলেটে আবু সাঈদের মৃত্যুর খবর সমগ্র দেশে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ, মাদরাসাসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে উত্তাল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র মীর মুগ্ধ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পানি খাওয়ানোর দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেদিন পুলিশের নির্মম গুলিতে মীর মুগ্ধসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র শাহাদাতবরণ করেন। তার পর থেকে ঢাকার রাজপথে নিরস্ত্র শিশু-কিশোর, ছাত্র-জনতার রক্তের স্রোত বয়ে যায়। ‘রিয়া গোপ’ নামের চার বছরের শিশুসহ অন্তত শতাধিক কিশোর এবং অসংখ্য ছাত্র-জনতার লাশের স্তূপে ঢাকা শহরকে পরিণত করা হয়! অসংখ্য ছাত্র-জনতা পুলিশের নির্দয়, নিষ্ঠুর গুলিতে আহত হন। আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ সকল শহীদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ভবনের সামনে। সেখানে ছাত্রলীগ ও পুলিশ, র্যাব একযোগে হামলা করে।
ফিলিস্তিনের গাজার নৃশংস গণহত্যার মতো বাংলাদেশ সরকারের পেটোয়া বাহিনীর পৈশাচিক বর্বরতায় ইতিহাসের সেই সব বিভীষিকাময় ঘটনার মধ্য দিয়ে মুহূর্তেই যেন মিসরের তাহরির স্কয়ার ও তিউনিসিয়ার বিপ্লবের আগুন তথা বিপ্লবী আরব বসন্ত মূর্তমান হয়ে ওঠে সমগ্র বাংলাদেশে। অতঃপর শুরু হলো বাংলা বসন্ত কিংবা বর্ষা বিপ্লব। দাম্ভিক সরকার তখনো বুঝতেই চাইল না, ক্ষমতার অপব্যবহার তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! পতঙ্গের পতন এলে যেমন সে আগুনের দিকেই ঝুঁকে পড়ে, তেমনি সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ ও দমন নীতি যেন তাকে ক্রমাগত আগুনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। একদিকে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেপরোয়া গুলিতে ছাত্র-জনতার প্রাণহানির সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি, অন্যদিকে মন্ত্রীদের বিতর্কিত বাজে বক্তব্য ও ন্যারেটিভ পাল্টে দিল বিপ্লবের গতিপথ। তীব্রতর বিক্ষোভে ফুঁসে উঠল সমগ্র দেশের লাখ লাখ তরুণ ছাত্র-জনতা।
আসলে ভাষা ও শব্দের ব্যবহারে মতাদর্শের প্রতিফলন কীভাবে ঘটে এবং তার প্রতিবাদ কেমন হওয়া উচিত, এক যুগের ‘জেন-জি’ জেনারেশন তার বহুমাত্রিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করল। প্রতিদিনকার আন্দোলনে সারা দেশে রাষ্ট্রীয় পুলিশ এবং সরকারদলীয় ক্যাডারদের হামলা, গুলি ও বর্বরতায় শহীদের সংখ্যা বাড়তে লাগল। রাজপথ, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ সারা দেশে অসংখ্য ছাত্র-জনতার রক্ত ঝরতে থাকল। রাজপথ, যানবাহন, ঘরবাড়ি অথবা হাসপাতাল কোথাও কোনো মানুষ নিরাপদ ছিল না। বিদ্যুৎবিহীন ব্ল্যাকআউট, কারফিউ, স্নাইপার গুলি কিংবা হেলিকপ্টার থেকে অনবরত গুলি (!), কোনো কিছুই ছাত্র-জনতার জাগরণকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। গুম, খুন নির্দয়-নিষ্ঠুর গোলাবর্ষণ কোনোটাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমাতে পারেনি। অকুতোভয় ছাত্র-জনতা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে শিখে নিল। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা-শপথের মাধ্যমে তারা আরও বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল।
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু, আর (১ জুলাই-৫ আগস্ট, ৩৬ দিনে) শেষ হলো শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। পৃথিবীতে বাংলাদেশের ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লব এমন এক ইতিহাসের জন্ম দিল, যা ইতিপূর্বে ভারতবর্ষের কোথাও ঘটেনি। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে যেভাবে নারী, শিশু, আবালবৃদ্ধবনিতা অংশগ্রহণ করেছিল, এ রকম নজির পৃথিবীতে বিরল।
মিসরীয় লেখক আলা আল আসওয়ানির স্বৈরাচার এবং স্বৈরতন্ত্র নিয়ে ‘The Dictatorship Syndrome’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। সেই বইতে স্বৈরাচারের কখন পতন ঘটে এবং কীভাবে তা সংঘটিত হয়, তার একটি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। তার মতে, স্বৈরাচারের পতনের বীজ স্বৈরাচারের হাতেই নিহিত থাকে। এ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন :
‘A dictator in his virtual and multi-delusional world is like a person driving a car with no brakes or rear-view mirror. He drives without the least notion of the surroundings he is driving through, and he cannot stop the car even if he wants to. Under these circumstances, the car will end up crashing horribly. Even if it does not happen today, then it will tomorrow or the next day.’
‘একজন স্বৈরশাসক তার ভার্চুয়াল এবং বহুমুখী জগতে ব্রেক এবং রিয়ার-ভিউ মিরর ছাড়াই গাড়ি ড্রাইভ করা ব্যক্তির মতো। সামান্যতম কোনো ধারণা ছাড়াই তিনি গাড়ি চালিয়ে যান, তিনি চাইলেও গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। তেমনি চাইলেই গাড়িটি থামাতে পারেন না। এমন পরিস্থিতিতে আজ না হলেও আগামীকাল কিংবা পরশু, গাড়িটি অবশ্যই ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হবে।’
বিগত সরকারের ১৫ বছরের বিবেকবর্জিত গণবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং নির্যাতন, নিপীড়ন সমস্ত মানবিকতাকে হার মানিয়ে দিয়েছিল। সর্বশেষ ২৪-এর ডামি নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার দমন-পীড়নে বেপরোয়া এবং নিষ্ঠুরতা চরম পর্যায়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে, জুলাইয়ের মাসব্যাপী ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমন-পীড়নের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করা শুরু করে। সরকার যতই পৈশাচিক ও ভয়ংকর হয়ে উঠছে, নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা ততই ক্ষিপ্র হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও কাঠামোগুলো ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। একটা সময় সরকারের মসনদ তাসের ঘরের মতো তছনছ করে দিয়েছিল। ২৪-এর সেসব ঘটনা মনে করতেই এখনো গা শিউরে ওঠে।
২৪-এর গণবিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থান বারবার, প্রতিবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে সেই সব আগুনঝরা দিনগুলোর কথা। মানুষ যখন মৃত্যুকে ভয় করে না, কোনো মারণাস্ত্র অথবা কোনো প্রতিবন্ধকতাই তাকে আটকে রাখতে পারে না এবং আন্দোলন দমাতে পারে না।
সবার প্রত্যাশা, জুলাই বিপ্লবের রক্তাক্ত স্মৃতিকে ধারণ করেই স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের আগামীর স্বপ্ন পূরণ হবে। বাংলাদেশের মানুষ সব সময় যুদ্ধকে জয় করে গণমানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির পথ প্রশস্ত করেছে। ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন, মহান ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেই ২৪ গণঅভ্যুত্থান পৃথিবীর বুকে যে ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে, তা কখনো মুছে ফেলা যাবে না।
ইতিহাসের শিক্ষা নেওয়ার অর্থ হলো অতীতের ঘটনা ও অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞান অর্জন করা, যা বর্তমান ও ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তের আলোকে উত্তম রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে সহায়তা করে। মানুষই ইতিহাসের জনক। কিন্তু এটাও সত্যি, ‘কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না’Ñএ কথাটি বলেছেন কার্ল মার্কস।
একটি গণঅভ্যুত্থান ও গণবিপ্লবের ইতিহাস থেকে পতনের অতলে নিমজ্জিত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদীর যেমন শিক্ষা নিতে হবে, তেমনি যারা বিপ্লব সংঘটিত করে, তাদেরও শিক্ষা নেওয়া উচিত। বাঙালি জাতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিস্মৃতিপরায়ণ। সহজেই অতীতের ইতিহাস ভুলে যায়! সুখের বাতাবরণে তাদের জীবনের কঠিনতম দিনের কথা মনে রাখে না।
স্বাধীনতার পূর্বশর্ত হলো তাকে ধরে রাখার ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশে সেটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা তাদের নিজেদের রাজনৈতিক ও দলীয় স্বার্থে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করেছে। সকল সুযোগ-সুবিধা নিজেদের ভাগে রেখে শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
সত্যবোধ ও অতীতের সত্য ঘটনাপ্রবাহই ইতিহাসের শক্তি। ইতিহাস সব সময়ই চলমান। মানুষের গতিপথ বন্ধ করা গেলেও ইতিহাসকে কখনো রুদ্ধ করা যায় না। সেটি আমাদের মনে রাখতে হবে। এ জন্যই ইতিহাস সবচেয়ে শক্তিশালী। যে শুধু সত্যকে প্রতিষ্ঠাই করে না, মানুষের ভেতরকার বিভ্রান্তি দূর করে, মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে। ইতিহাসের শিক্ষা নিয়েই মানুষ পৃথিবীতে মানুষের ভুবনকে সার্থক, চিরস্থায়ী ও স্মরণীয় করে তোলে। আমরা যেন ইতিহাসকে কখনো ভুলে না যাই।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক