জুলাই ’২৪ আন্দোলনের পক্ষ দুটিÑসরকার ও ছাত্র-জনতা। আমরা শহীদ ছাত্র-জনতা নিয়ে রচিত কবিতা-ছড়ার কথা বলেছি। এবার আন্দোলন দমন ও বন্ধ করতে আওয়ামী লীগ সরকার গৃহীত নানা পদক্ষেপের কথা বলা যায়। সরকার প্রথম দিকে উদাসীন ছিল, কিন্তু পরে দমন-পীড়ন নীতি গ্রহণ করলে অনেক প্রাণহানি ও সম্পদহানি ঘটে। আন্দোলন চলাকালে ও পরবর্তী সময়ে রচিত কবিতা-ছড়ায় হত্যাসহ নির্যাতনের বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে। ভাষার অন্য আঙ্গিক ও মাধ্যমের চেয়ে কবিতা-ছড়ার ধারণক্ষমতা অধিক, প্রকাশশক্তি বেশি। কবিদের দৃষ্টিতে সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার স্বৈরাচার ভাবমূর্তি অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। ১৬ বছর ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী হয়ে তিনি শুধু স্বৈরাচার নন, স্বেচ্ছাচারীও হয়ে ওঠেন। রাষ্ট্রের সবকিছু তার অঙ্গুলি নির্দেশে চলে। দিনের পর দিন সব শ্রেণির মানুষ তা প্রত্যক্ষ করেছে। মানুষ ব্যক্তিস্বাধীনতা বাকস্বাধীনতা নাগরিক অধিকার সামাজিক নিরাপত্তা ন্যায়বিচার জীবনজীবিকা নিরাপত্তা ইত্যাদি পায়নি, উপরন্তু হামলা-মামলা, জেল-জুলুমের ভাগীদার হয়ে নির্যাতন ভোগ করেছে এবং অনেকে গুম-খুনের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। বিশেষ করে, সরকারবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করে দমন-পীড়নের ‘স্টিম রোলার’ চালানো হয়েছে। সমাজের বিবেক বলে পরিচিত মুক্তমনা কবি-সাহিত্যিকও সরকারের রুদ্ররোষ থেকে রেহাই পাননি। তারা যখন কলম ধরার সুযোগ পেয়েছেন, তখন স্বভাবতই তাদের জমানো ক্ষোভ ও বিষবাণ শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তাদের আক্রমণ, বিদ্রপ, কটাক্ষ করে নানা কবিতা-ছড়া রচিত হয়েছে।
(১) আন্দোলন চলাকালে ‘হিপোক্রেট’ নামে একটি কবিতা লিখেছেন কামরুল হাসান লিটু। ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’ পত্রিকায় ২৪ জুলাই সংখ্যায় তা প্রকাশিত হয়। হিপোক্রেট বলতে শেখ হাসিনাকে বোঝানো হয়েছে। ১২ পঙক্তির কবিতার চরণগুলো ছিল এ রকম : ‘তোমার মতো আমরা নেতিবাচকতার দিকে পাল্টে যেতে পারি না।/ সে জন্যই আজ কিশোর ছাত্রদের লাশের সারি আমাদের কাঁদায় ভাবায়।/ এখন তোমার আর রাসেলের কথা মনে পড়ে না।/ পড়লে অন্য রাসেলদের মৃত্যু হতে দিতে না।/ স্বজনহারাদের ব্যথা তুমি এখন আর বোঝো না/ হৃদয় দিয়ে অনুভব করো না।/ এটা শুধু তোমার কাছে শুধুই কথার কথা।’ রাসেল শেখ হাসিনার কনিষ্ঠ ভ্রাতা, ১৫ আগস্ট সেনাদ্রোহের সময় নিহত হন। স্বজন হারানোর জন্য তিনি কাঁদেন, কিন্তু অন্যরা নিহত হলে তিনি বিচলিত হন না। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র নিয়েও দ্বিচারিতা করেছেন। কবির উক্তি : ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো সাম্যের, বিভাজনের না/ তবে কেন আজ রক্তাক্ত বাংলা?/ তুমি ভুলে যেতে পারো, ঘুরে যেতে পারো/ কিন্তু আমি ও আমরা গণতন্ত্র, অধিকার, সাম্য ভুলতে পারি না।/ তুমি হিপোক্রেট হতে পারো, আমরা না।’ কথাগুলো সরল ও সহজবোধ্য, কিন্তু অতি সত্য ও বাস্তব। ইংরেজি হিপোক্রেটের বাংলা প্রতিশব্দ ভণ্ড, কুহক, মোনাফেক।
(২) আবু কাজী রুবেল লিখেছেন ছড়া, নাম ‘অধিকার’। ‘ন্যায্য চাইলে গুলি করিস আইয়ুব খানের মতো,/ আরো রক্ত দেবে বাঙালি রক্ত চাস কত?/ রক্তে কেনা দেশটা বেচে সাজলি মা রানি,/ পাকির মতো ছাত্র মেরে দেখাস রাঙানি।/ দম্ভ নেশায় গুলি চালাস রক্তে মেলাস অঙ্ক,/ মায়াকান্না কাঁদিস তুই মুক্তিযোদ্ধার কলঙ্ক।’ (সাপ্তাহিক ঠিকানা, ২৪ জুলাই ২০২৪)। ‘পাকি’ অর্থাৎ পাকিস্তানি সেনারা গুলি চালিয়ে বাঙালি নিধন করেছিল; এখন তার অনুগত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি করে বাঙালি সন্তানদের হত্যা করে। ভয়ের মধ্যে তফাত কোথায়? ‘দম্ভের নেশায়’ গুলি চালিয়ে মানুষ মারেন, আবার শোক দিবস পালন করে ‘মায়াকান্না’র অভিনয় করেন। এখানে শেখ হাসিনার খুনিরূপে আর কপটচারিতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
(৩) ফয়েজ রেজা ‘ছররা গুলির ছড়া’য় স্বগোক্তির আঙ্গিকে যা বলেছেন, তা শেখ হাসিনারই দম্ভোক্তি ও অনৃতভাষণ। ‘আমার কথায় প্রধান খবর সকল পেপার ছাপায়/ সত্য কথা হারিয়ে যায় মিথ্যা ঝাঁজের চাপায়।/ এই কটা দিন নেট ছিল না এ কথা কে বলল?/ পৃথিবীতে নেট ছাড়া কি দেশ বাতাসে চলল?/ ... দেশের ভেতর যা ঘটে তা অপশক্তি ঘটায়/ দেশবিরোধী শক্তিগুলো ভুয়া খবর রটায়।... / সবার বুকে ছররা গুলি ছুড়ে করব ঠান্ডা/ বিশ্ববাসী যা বলে তা-মিথ্যা প্রোপাগান্ডা।’ (ঐ) অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা জানেন, ছড়ার প্রতিটি শব্দ অক্ষরে অক্ষরে সত্য।
(৪) যখন ছাত্র-জনতার আন্দোলন তুঙ্গে, তখন রওশন আরা মুক্তা লেখেন ‘গোল্ডফিশের কান্না’। ১৫ জুলাই আবু সাঈদসহ ৬ জনের মৃত্যু ও অন্য অনেক জনের আহত হওয়ার ঘটনা আর থামেনি, বরং দিনে দিনে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯ জুলাই বিক্ষুব্ধ জনতা রামপুরা টেলিভিশন কেন্দ্র, মিরপুরের বিআরটিএ অফিস, মহাখালীর ডেটা সেন্টার ও সড়ক সেতু ভবন, উত্তরা ও মিরপুরের দুটি মেট্রোরেল স্টেশন ইত্যাদি সরকারি প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। ছাত্র-জনতার সঙ্গে সংঘর্ষে কতক পুলিশও হতাহত হন। শেখ হাসিনা হাসপাতালে গিয়ে আহতদের খোঁজখবর নেন এবং নবনির্মিত মেট্রোরেল স্টেশন পরিদর্শনে গিয়ে স্টেশনের ভাঙচুর অবস্থা দেখে অশ্রুরোধ করতে পারেননি। মানুষের হতাহতের বিবরণ না দিয়ে যখন সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রচারযন্ত্রে মেট্রোরেল ও ডেটা সেন্টারের ক্ষয়ক্ষতির ও শেখ হাসিনার দ্বিচারিতার কথা ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছিল, তখন রওশন আরা মুক্তা এই কবিতা লিখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন। রচনা ও প্রচারকাল ২৪ জুলাই ২০২৪। ‘মাছের মার কান্না’ বলে লোকপ্রবাদ আছে, যার অর্থ নিরর্থক দুঃখ প্রকাশ। এরই নগর সংস্করণ ‘গোল্ডফিশের কান্না’। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় কবিতার শিরোনামটি চমকপ্রদ হয়েছে। কবির বিষয় নির্বাচন প্রাসঙ্গিক, বাচনভঙ্গি অনির্বচনীয়। সাহিত্যের একটা নতুন ভাষা, নতুন বাগভঙ্গি তৈরি হয়েছে। প্রতীক-উপমায় কবিগণ তাদের প্রতিবাদের কথা নিঃসংকোচে বলছেন। তারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের ক্ষোভ শঙ্কা সাহস দ্রোহের কথা বলছেন, তুলে ধরছেন অচলায়তন ভেঙে ফেলে নতুন সম্ভাবনার ও উন্মেষের কথা। কবি বলেন, ‘একটা বিল্ডিংয়ের মূল্য/ তোমার ছেলের জীবনের চেয়ে অনেক বেশি।/ একটা ওভারব্রিজের দাম/ তোমার হাজার ছেলের লাশ দিয়েও কি চুকাতে পারবে?/ একটা মেট্রোস্টেশন গর্ভে ধরতে পারবে তুমি?/ ... একটা বিল্ডিংয়ের মূল্য/ তোমার রক্ত-মাংসের সন্তানের চেয়ে/ আসলেই অনেক বেশি।/ ... চুমু খেয়ে ঐ ইট সিমেন্টের শরীরে/ গাড়িগুলোকে শুইয়ে দিও হাত বুলিয়ে/ পদ্মা সেতুটাকে পাঠিও ভার্সিটিতে,/ পাবলিকে না হয় প্রাইভেটে/ আর রাতে ঘরে ফেরার অপেক্ষা করো/ প্রিয় ওভারব্রিজটার, আর স্টেশনটার।/ ... ভুলে যেও, তুচ্ছ নগণ্য ঐ মনুষ্য সন্তান/ কখনও তোমাকে মা ডেকেছিল/ তোমার ঘরে এখন বিটিভি,/ তোমার বিছানায় এক্সপ্রেসওয়ে/ তোমার আঁচল ধরে আছে মেট্রোরেল/ আর কী চাই তোমার?/ যাও চুমু খেয়ে নাও ভবনটাকে, চেয়ারটাকে, হেলিকপ্টারটাকে!/ তারপর ঘুমিয়ে যাও/ সকালে আবার তোমার বিল্ডিংগুলোর ক্লাস আছে।’
উদ্ধৃতি দীর্ঘ হলো কবির ক্ষোভ বিদ্রপ পরিহাসের মাত্রাটা বোঝার ও বোঝানোর জন্য। শক্তিধর স্বৈরাচার শাসক শেখ হাসিনা তখনো ক্ষমতাসীন; তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এরূপ সাহসোক্তি দ্বিতীয় মেলা ভার। প্রতিটি বাক্যই যেন একেকটি কশাঘাত! আমাদের বিশ্বাস, জুলাই গণআন্দোলন মানুষকে এমনই দুঃসাহসী করে তুলেছিল। কবিতার অভিনব নামকরণের উৎস কী? ‘ফাইন্ডিং ইমো’ নামে একটি শিশুতোষ মুভি কার্টুন দেখেছি, যেখানে বাবা ও ছেলে গোল্ডফিশের প্রকারভেদ ‘ক্লাউনফিশে’র কথাচিত্র রয়েছে। বাবার নাম মিলন, ছেলের নাম ইমো। সমুদ্রের বুকে আপন বাসভূমিতে তারা নিরাপদে ছিল। একদিন ছেলে পানির উপর স্তরে উঠে গেলে ডুবুরির জালে ধরা পড়ে এবং একজন ডেন্টিস্টের ট্যাঙ্কে বন্দী হয়। বাবা ছেলেকে না দেখো কান্নায় ভেঙে পড়ে এবং ডরি নামে একটি দরদি গাঢ় নীল রঙের মাছ ও সমুদ্রপাখি সিগালের সাহায্যে নানা বাধা অতিক্রম করে ছেলেকে উদ্ধার করে। কার্টুনটি কবিতার নামকরণের উৎস হলেও হতে পারে। তবে আমার অনুমান ঠিক হয়নি। কবির সঙ্গে আলাপ করে জানলাম ‘গোল্ডফিশ মেমোরি’র কথা। তিনি বলেন, ‘মধ্যবিত্তের মন তো আসলে গোল্ডফিশ। এই কাঁদছি, কালই হয়তো ভুলে যাব। আমার মেমোরিকে দখল করেই তো শাসন করা যাচ্ছে আমাকে! কবিতার নাম লিখলাম গোল্ডফিশের কান্না। ... এখনো অবিশ্বাস্য লাগে, এমন দিন কেটেছে আমাদের! ইন্টারনেট বন্ধ করে কী নির্বিচারে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, আর কী নির্লজ্জভাবে কিছু পোড়া বিল্ডিং দেখিয়ে সত্য লুকানোর চেষ্টা করেছিল কিছু মানুষ। আমাদের গোল্ডফিশের মেমোরিতে জানি না কত দিন থাকবে এই শহীদদের আত্মত্যাগের কথা? যাদের পবিত্র শরীরের ভগ্নাংশে ফুলে-ফলে পরিপূর্ণ হয় এই পৃথিবী।’ আমরা কবিতাটি নিয়ে এত কথা বললাম, তার কারণ এর কম্পোজিশন, শব্দভান্ডার, বাকভঙ্গিমা ও চিত্রকল্প সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর প্রেক্ষাপট জানা না থাকলে মনে হবে, উদ্ভট চিন্তা! উদ্ভট বাকবিস্তার ও বাক্প্রতিমা!
রফিক আজাদ একটি কবিতা লিখেছিলেন, নাম ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো’। ১৯৭৪ সাল, দেশে আকাল চলছে, চারদিকে ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার। কবি কালের জনমানুষের প্রচণ্ড ক্ষুধার জ্বালা অন্তরে ধারণ করে লিখেন, ‘দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে/ অবশেষে যথাক্রমে খাবো : গাছপালা নদী-নালা/ গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত/ চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব প্রধান নারী/ উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী/ আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ।’ ‘হে মহাজীবন’ কবিতায় সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/ পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ (ছাড়পত্র)। ছাড়পত্রের কবিতাগুলো ১৯৪৩-৪৭ সালের মধ্যে রচিত হয়; ১৯৪৪-৪৫ সালে অখণ্ড বাংলার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ কবি প্রত্যক্ষ করেন। এখানেও ক্ষুধা জঠরজ্বালা ও অন্নের জন্য হাহাকার ধ্বনিত হয়েছে। কবিদের প্রচণ্ড আবেগ, ক্ষোভ ও দ্রোহচেতনা থেকে এরূপ কবিতার উদ্ভব হয়। কালেভদ্রে এমন সৃষ্টির দেখা মেলে। এই অর্থে আমি ‘গোল্ডফিশের কান্না’কে একটি অনন্য ও অচিন্ত্যনীয় কবিতা বলে মনে করি।
শেখ হাসিনাকে নিয়ে এরূপ কবিতা-ছড়া আরও রয়েছে। মনে রাখা দরকার, ঝড়টা বটগাছে বেশি লাগে। রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন শেখ হাসিনা, সে জন্য সবার ‘টার্গেট’ হন তিনি। তার ওপর দিয়ে ‘কালবৈশাখীর ঝড়’ বয়ে গেছে। ঝড়ের তীব্রতায় বটগাছ সমূলে উৎপাটিত হয়। সামনে আরও কত কি ঝড়ঝাপ্টা আছে, তা কে জানে! এবার তৎকালীন সরকারপক্ষের অন্যদের কথা বলি। শিল্পপতি সালমান এফ রহমান সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। তাকে নিয়ে ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’ পত্রিকায় দুটি ছড়া প্রকাশিত হয়। এর একটি ‘দাড়িহীন দরবেশ’, লিখেছেন সালেম সুলেরী; অপরটি ‘দরবেশ, ও দরবেশ’, লিখেছেন হুমায়ুন ফিরোজ; প্রকাশকাল যথাক্রমে ১৪ ও ২১ আগস্ট ২০২৪। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে; প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন; দিন কতক পরে সালমান ফজলুর রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মাঝির ছদ্মবেশে নৌকাযোগে ভারতে পালাবার চেষ্টায় ধরা পড়ে কারাবাসে যান। সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর ছবিতে দেখা যায়, তাদের পরনে লুঙ্গি, মাথায় মাথাল; সালমান রহমানের মুখভর্তি সাদা দাড়ি নেই, কেটে ফেলেছেন। এরই প্রেক্ষাপটে ‘দাড়িহীন দরবেশ’ ছড়াটি রচিত হয়। ২০ পঙ্্ক্তির এই ছড়ায় সালেম সুলেরী বলেন, ‘দাড়ি কেটে দরবেশ, লুঙ্গিতে দেহ/ নদীপথে পাড়ি যেন নেই সন্দেহ।/ ... আইনের উজির যে আনিসুল হক/ সেই ছিল সাক্ষী হয়ে-এঁকে দিল ছক।/ ... ‘নৌকা’ প্রতীক প্রিয়, নৌকাতে পাড়ি,/ কে জানিত-নৌসেনা পেতে আছে আড়ি।/ এবার জেলের ভাত, চরকাটা কাটো/ দশ দিন সাধু বেশ, একদিনে খাটো।/ সকালেই আমির আর সাঁঝেই ফকির,/ হাতকড়া পরা রাত-মেঝে বা চকির।’
ফিরোজ হুমায়ুনের বিদ্রপের ভাষাটি আরও তীব্র ও শাণিত। তিনি বলেন, ‘শুভ্র দাড়ি শুভ্র কেশ, সবাই বলে দরবেশ।/ চেহারাতে এক মহামানব, আসলে এক আস্ত দানব।/ ও দরবেশ ও দরবেশ, তোমার আজ একি বেশ?/ কোথায় গেল এত তেজ? আজ দেখি না তো তার লেশ?/ ... কোথায় তোমার আপু মণি? কোথায় তোমার সোনার খনি?/ কোথায় তোমার বাড়ি গাড়ি? কোথায় তোমার প্রিয় দাড়ি?/ শেয়ারবাজার করেছ যে শেষ, তুমি কি সেই দরবেশ?/ ... জনমানুষের আর সইছে না তর, তুমি কবে যাবে আয়নাঘর?’ পাকা গোঁফদাড়ি ও পোশাক-পরিচ্ছদে ‘দরবেশ’-তুল্য মনে হলেও ঋণখেলাপির নামে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং সিন্ডিকেট করে শেয়ারবাজারের কোটি কোটি টাকা লুটপাট বছরের পর বছর ধরে মানুষ দেখে ও শুনে আসছে। এর ওপর ভারতে পালানোর ব্যর্থ চেষ্টা। তার প্রতি লোকের ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ ছিল না; তিনি লোকচক্ষে পরিহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছেন। বকধার্মিক প্রতারক ভণ্ড চরিত্রের কারণে তার প্রতি বিদ্রƒপবাণ নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
৩৬ জুলাই আন্দোলনের নানা সময়ের নানা ঘটনা অবলম্বনে বহু কবিতা-ছড়া রচিত হয়েছে। ‘ছোটদের সময়’ শীর্ষক সংকলনে ৪৮টি ছড়ার মধ্যে ১৩টির শিরোনাম জুলাইকেন্দ্রিক, ১টিতে আগস্টের নাম আছে। প্রবীণ কবি ও ছড়াকার আবদুল হাই শিকদার ‘জুলাই বাংলাদেশ’ ছড়ায় বলেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তমাখা জুলাই অনিঃশেষ,/ জুলাই তুমি স্বাধীন সকাল তুমিই বাংলাদেশ।/ তুমি আমার কালবৈশাখী টর্নেডো টাইফুন,/ তুমি আমার জোছনা ও রোদ ভাতের থালায় নুন।/ তুমি আমার দীপ্ত বিজয় ধান কাউনের গান,/ তুমি অসীম অন্ধকারে আলোর অভিযান। /... আনল জুলাই মুক্ত স্বদেশ ফিরল স্বাধীনতা,/ করল দাফন দাসত্ব আর সকল অধীনতা।/ ... সংহতি আর ঐক্য দিয়ে বিভেদ করো শেষ,/ জুলাই তুমি একলা আশা তুমিই বাংলাদেশ।’ এখানে জুলাই আন্দোলনের অবদান ও প্রাপ্তির বিষয় বর্ণিত হয়েছে।
আমীরুল ইসলাম ‘জুলাই-বিপ্লবের ছড়া’তে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীগুলো লুটেরা আর বাটপার/ জুলাই মাসে জনরোষে হঠাৎ তারা মাঠপার। মানুষ মরে শিশু মরে তাও কথা কয় আরাফাত/ জুলাই মাসে তৈরি হলো নতুন ধারাপাত।’ ‘লাল জুলাইয়ের ছড়া’য় আমিরুল মোমেনীন মানিক আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ শেষ হয়নি যুদ্ধ/ তিতুমীর আবরার প্রেরণায় বারবার/ ...ওয়াসিমের রক্ত ধুয়ে উঠে নতুন সূর্য/ বেজে উঠুক স্বদেশ গড়ার নবীন রণতূর্য।/ ... এই কারণে ঐক্য গড়ে দ্রোহ করার দিন এলো/ দ্রোহের ফলে ফ্যাসিবাদ চিরতরে পালালো।’
‘তখন জুলাই মাস’ ছড়ায় আরিফ বখতিয়ার আন্দোলনকে চিত্রিত করেছেন এভাবে : ‘হঠাৎ সেদিন আকাশ ভেঙে সূর্য হলো লাল/ জোয়ার এলো সাগরজুড়ে বাঁধভাঙা উত্তাল।/ ... সবাই যখন কাঁপছে ভয়ে স্বৈরাচারের ডর/ তখন জুলাই, আমজনতার ভাঙলো গলার স্বর।/ ভাঙলো যুবক শিশু-কিশোর স্বৈরাচারের দোর/ সাঈদ নিজে বুক পেতে দেয় আনতে নতুন ভোর।/ ...আকাশ থেকে ছররা গুলির ভয় ছিল না মোটে/ রক্তনদী বইয়ে দিয়ে সবাই তখন ছোটে।/ ... সব হারিয়ে মা পেল ফের মুক্ত পরিবেশ/ স্বৈরাচারী যায় পালিয়ে স্বাধীন হলো দেশ।’
বিলাল হোসেন নূরী ‘দ্রোহের জুলাই’ ছড়ায় আন্দোলনের কারণ রূপ পরিণতি সম্বন্ধে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ ছিল নাকের ডগায় মুখের জবান রুদ্ধ/ চারিদিকে শুধু হাহাকার আর অঘোষিত যুদ্ধ।/ কথায় কথায় জেল ও জুলুম কথায় কথায় হত্যা/ হীরক রানীর রাজ্যে ছিল না মানুষের নিরাপত্তা।/ রাজপথে নামে যুবক-তরুণ বাজায় তুমুল তূর্য/ মরবে না হয় জাগাবে এবার বিপ্লবী এক সূর্য।/ ...তারপর ঘটে বিশাল ঘটনা, জালিম পালায় দিল্লি/ দেড় দশকের স্বৈর-শোষক নিমিষেই হলো বিল্লি।’ ফারুকের ‘জুলাই বিপ্লব’ ছড়াটিও আন্দোলনের কারণ রূপ পরিণতি নিয়ে রচিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার দুঃশাসনে পিষ্ট যখন দেশটা,/ জাগলো সবাই দেখবে বলে জালিমশাহির শেষটা।/ উঠলো জেগে ঘুমিয়ে থাকা দামাল ছেলের দল,/ কাঁপিয়ে দিতে তখত তাউস সরিয়ে জগদ্দল।/ উঠলো স্লোগান জ্বলল মশাল ছড়িয়ে গেল আগুন,/ আগস্ট মাসে পাঁচ তারিখে আসলো নেমে ফাগুন।’
আন্দোলনের কারণ রূপ পরিণতি বিষয়ে সবার কণ্ঠে একই ভাষা-স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও তার সরকারের দুঃশাসন, আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ, আবু সাঈদ-মীর মুগ্ধসহ শত শত নিরীহ জনের প্রাণনাশ ইত্যাদি। অবশেষে স্বৈরশাসকের পতন, ছাত্র-জনতার বিজয় এবং নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলো। [চলবে]