১৯৬৩ সালে নির্মিত মার্কিন চলচ্চিত্র ‘দ্য গ্রেট এসকেপ’ (The Great Escape)-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মানির কারাগারে আটক নাজিবিরোধী বেশ কিছু বন্দীর দুঃসাহাসিক পলায়নের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার এক অবিস্মরণীয় বিপ্লবের মুখে সে সময়কার স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা দেশত্যাগ বা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। জার্মান কারাগার থেকে বন্দীদের পলায়নের সঙ্গে শেখ হাসিনার পলায়নের ঘটনাপ্রবাহের কোনো মিল না থাকলেও দুটো পর্ব বা অধ্যায়ই ছিল ঘটনাবহুল ও শ্বাসরুদ্ধকর। বন্দীদের পলায়নের পেছনে যে কারণটি মুখ্য ছিল, সেটি হলো তাদের ধরে কারাগারে ফিরিয়ে আনতে যে বহুসংখ্যক নাজি সৈনিককে মাঠে নামতে হবে, তাতে ব্যাটলফ্রন্টে নাজি সৈন্যের সংখ্যা হ্রসের কারণে মিত্র বাহিনী যুদ্ধে কিছুটা হলেও সুবিধা পাবে। অপরদিকে দীর্ঘ দেড় দশকের সীমাহীন নিপীড়ন-নির্যাতন ও অপশাসন থেকে মুক্তির অদম্য আকাক্সক্ষা বাংলাদেশের আপামর মানুষকে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করে।
৫ আগস্ট স্বৈরশাসকের বাসভবন গণভবনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চলমান বিপ্লব দমনের পাশাপাশি জনরোষ থেকে তাকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, বাঁচানো যায়, তা নিয়ে নানামুখী ব্যাপক তৎপরতা শুরু হয়। সেদিন ভোর থেকেই স্বৈরশাসক যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সব বাহিনী ও দলীয় সশস্ত্র ক্যাডারদের বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতাকে আরও কঠোর ও সহিংস উপায়ে দমন ও প্রতিহত করার নির্দেশ দেন। বিদ্যমান পরিস্থিতি দেখে সব বাহিনী প্রধানের মধ্যে সেই আদেশ প্রতিপালনে অনীহার মনোভাব দেখে স্বৈরশাসক অত্যন্ত মর্মাহত হন। পুলিশের জনৈক কর্মকর্তাকে এ সময় বলতে শোনা যায়, আমরা ছাত্র-জনতার দিকে গুলি করলে একজন পড়ে যায় (নিহত), কয়েকজন রাস্তায় পড়ে কাতরাতে থাকে (আহত) কিন্তু সেদিকে ভ্রক্ষেপ না করে পরমুহূর্তে ৩০ জন আমাদের দিকে তেড়ে আসতে থাকে। কথাটা শুনে স্বৈরশাসক চিন্তিত বদনে সেখানে উপস্থিত তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সেনাপ্রধানের দিকে তাকান। সেনাপ্রধান তার দেহভঙ্গির (Body Language) মাধ্যমে পরোক্ষভাবে পরিস্থিতি উত্তরণে তার পক্ষেও তেমন কিছু করার নেই বলে জানিয়ে দেন।
এ সময়ে গণভবনে খবর আসে ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশপথ দিয়ে কারফিউ এবং বিভিন্ন বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা ঢাকায় শাহবাগের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে। শাহবাগ থেকে তারা গণভবনের দিকে এগোবে। শাহবাগের দিকে যাত্রাপথে উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকার চানখাঁরপুলসহ বহু এলাকায় পুলিশের গুলিতে বহুসংখ্যক ছাত্র-জনতার হতাহত হওয়ার খবর আসতে থাকলে গণভবনে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। চানখাঁরপুল এলাকায় ছয়জন নিহত হয়। এখানে নিহত গেন্ডারিয়া আদর্শ অ্যাকাডেমির দশম শ্রেণির ছাত্র শাহরিয়ার খান আনাসের পকেটে মর্মস্পর্শী ভাষায় লেখা একটি চিঠি পাওয়া যায়, যেখানে সে তার বাবা-মা ও সবার উদ্দেশে বিপ্লবে তার অংশগ্রহণের যৌক্তিকতা তুলে ধরে। জুলাই বিপ্লবে আনাসের মতো আরও শত শত মানুষ নিহত ও কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়। এ সময় ছাত্র-জনতার বিপ্লব দমন ও প্রতিহত করার চিন্তা বাদ দিয়ে গণভবনের দিকে ধাবমান বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতার প্রচণ্ড রোষ থেকে ব্যাপক রক্তপাত এড়িয়ে স্বৈরশাসকের আশু সম্ভাব্য করুণ ও মর্মান্তিক মৃত্যুকে কীভাবে ঠেকানো যায়, সেটা হয়ে ওঠে গণভবনে উপস্থিত সব কর্মকর্তা, বিশেষ করে সেনাপ্রধানের মুখ্য চিন্তার বিষয়। তথ্যমতে, স্বৈরশাসককে প্রাণে বাঁচানোর একমাত্র পথ হিসেবে তাকে দেশত্যাগ তথা পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলে তিনি রাগে ফেটে পড়ে কিছুক্ষণ গাইগুই করে নিরুপায় হয়ে অবশেষে তাদের পরামর্শ মেনে নেন। ইতিমধ্যে স্বৈরশাসকের মহাপলায়ন পর্ব (The Great Escape) সমাধার জন্য ভারতের কয়েকজন কর্মকর্তা, যেমন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল প্রমুখের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে স্বৈরশাসকের ভারতে চলে যাওয়ার পাকা ব্যবস্থা চূড়ান্ত করে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর একটি পরিবহন বিমানে করে তাকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়।
মার্কিন গৃহযুদ্ধে (১৮৬১-১৮৬৫) দাসপ্রথা বিলুপ্তির পক্ষে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ডাকে সাড়া দিয়ে রোড আইল্যান্ডের তরুণ আইনজীবী সুলিভান ব্যালু (Sullivan Ballou) ইউনিয়ন আর্মিতে যোগ দিয়ে মেজর পদে উন্নীত হন। দাসপ্রথা বহাল রাখার পক্ষের কনফেডারেট আর্মির সঙ্গে ওয়াশিংটনের বুল রান এলাকায় এক যুদ্ধে তিনি আহত হয়ে পরে মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার স্ত্রীর উদ্দেশে ‘My very Dear wife’ সম্বোধন করে লেখা এক পত্রে জাতির প্রয়োজনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে গর্বিত বলে জানান। এই পত্রটি মার্কিন ইতিহাসের এক অসামান্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। তেমনিভাবে বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবে রংপুরের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আবু সাঈদের পুলিশের বন্দুকের দিকে তাকিয়ে ‘বুক পেতে দিয়েছি, গুলি কর’, ঢাকার উত্তরায় মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে বিপ্লবে যুক্ত ছাত্র-জনাতর পানির পিপাসা মেটাতে মীর মুগ্ধের পানির বোতল বিতরণের ‘পানি লাগবে পানি’ বলার সাহসী উচ্চারণ আগামী দিনে বিশ্বব্যাপী বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীদের জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
সব শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সংগঠিত জুলাই আন্দোলন বিশ্ব ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক বিপ্লবের মর্যাদা লাভ করেছে। এই বিপ্লবের সাফল্য আগামীতে বৈষম্য, অপশাসন, দুর্নীতি, প্রতিক্রিয়াশীলতা মুক্ত একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে আলোকবর্তিকা হবে-সেটাই আমার মতো সাধারণ মানুষের (Commoner) প্রত্যাশা।
লেখক : কলামিস্ট