যেকোনো জাতিকে তার সংস্কৃতি দিয়ে ভালো করে চেনার সুযোগ ঘটে। উৎসব একটি জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে চিহ্নিত করার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বলার অপেক্ষা রাখে না, পয়লা বৈশাখ বাঙালি জাতির সংস্কৃতিকে শনাক্ত করার অন্যতম উপাদান হিসেবে বিবেচিত।
সংস্কৃতি সদাই বহমান। নদীর পানির মতোই সে এক উৎস থেকে আরেক উৎসে প্রবাহিত। প্রতিনিয়তই দেশ, কাল, সমাজ এবং সময়ের সঙ্গে সংস্কৃতির গভীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। সময়ের আবর্তনে একটি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়ও পরিবর্তন হয়। ঠিক একইভাবে বর্তমান ডিজিটাল যুগে বাংলার চিরায়ত উৎসবগুলোরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। বাঙালি জাতির গতি-প্রকৃতি ও মননেও পশ্চিমা সংস্কৃতি ছোঁয়াসহ বিভিন্ন কারণে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সংস্কৃতির এই ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়েই একটি জাতিসত্ত্বার বিকাশ ঘটে। বাঙালি জাতিও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে ভয়ের কথা হলো বর্তমান সময়ে আমাদের হাজার বছরের গর্বিত সংস্কৃতির ওপর নানা রকম ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বাংলা সংস্কৃতিকে গুঁড়িয়ে দিতে একদল কোমর বেঁধে লেগেছে। সেটি একটি দেশের সংস্কৃতির জন্য বিপজ্জনক আলামত।
ধর্ম সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান একটি অংশ। ধর্মের দিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে বঙ্গ দেশে বিভিন্ন রকম ধর্ম এসেছে এবং মানুষের লেনদেন ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের সঙ্গে নিয়ে আসা সংস্কৃতির প্রভাব ঘটেছে। বাংলায় হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, আউল-বাউল, বৈষ্ণব, শাক্ত আর সেই সঙ্গে আদিবাসীদের নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কৃতির মিলন ঘটেছে। সবার মিলিত সংস্কৃতিই হলো বাঙালি সংস্কৃতি। এ কথা মানতে হবে, প্রতিটি ধর্মের রয়েছে নিজস্ব কিছু আয়োজন। নিজস্ব কিছু রীতিনীতি ও আনুষ্ঠানিকতা। ধর্মীয় সেই অনুষঙ্গের ছাপ মানুষের প্রতিদিনের গার্হ্যস্থ জীবনে পড়বে, এমনটাই স্বাভাবিক। ধরা যাক, পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির কথাই। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই জাতিসত্ত্বার বিকাশ একই উৎস থেকে উৎসারিত হলেও পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের রান্নাবান্না, আচার-অনুষ্ঠান, বিয়ে-শাদি থেকে শুরু করে ভাষাগত দিক থেকেও একটি নিজস্বতা রয়েছে। এটিই সংস্কৃতির শক্তি ও সৌন্দর্য। মানুষের বিশ্বাস, আচার, ধর্ম এবং জীবনাচরণে এই ভিন্নতার ফুলগুলো দিয়ে একটি মালা গাঁথলে যে মালাটি তৈরি হবে, সেটাই হবে সেই জাতির সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতি সে কারণেই অনেক শক্তিশালী এবং তাৎপর্যপূর্ণ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় :
‘বাংলাদেশের ইতিহাস খণ্ডতার ইতিহাস। পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, রাঢ়, বরেন্দ্র ভাগ কেবল ভূগোলের ভাগ নয়; অন্তরের ভাগও ছিল তার সঙ্গে জড়িয়ে, সমাজের মিলও ছিল না। তবু এর মধ্যে এক ঐক্যের ধারা চলে এসেছে সে ভাষার ঐক্য নিয়ে। আমাদের যে বাঙালি বলা হয়েছে, তার সংজ্ঞা হচ্ছে আমরা বাংলা বলে থাকি।’
কবিগুরুর কথার সুরে সুর মিলিয়ে এ কথা খুব স্পষ্ট করেই বলা যায়, একটি দেশের সংস্কৃতি দিয়ে একটি জাতিকে চেনা যায়। একটি জাতি তার সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং ঐতিহ্যকে যত বেশি গর্বের সঙ্গে লালন-পালন করতে পারবে, তত নিজেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গর্বের সঙ্গে পরিচিত করে তুলতে পারবে। সেদিক থেকে বাঙালি এবং পয়লা বৈশাখ একে অপরের পরিপূরক। সংস্কৃতির এই বহমান ধারাই বাঙালি জাতিকে যুগ যুগ ধরে জিয়ে রাখবে এবং পৃথিবীর অন্যান্য জাতির পাশাপাশি বাঙালি জাতিকে তার নিজস্ব পরিচয়ে পরিচিত করে পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখবে।
এ কথা মানতে হবে যে হাজার বছরের সময়ের আবর্তনে বাঙালি সংস্কৃতি বিভিন্ন সময়ে নতুন মাত্রা পেয়েছে এবং বাঙালির সংস্কৃতির গায়ে নতুন নতুন পালক যোগ হয়েছে। আমরা জানি, বাঙালি জাতি সেই আদিকাল থেকেই বিদেশি শাসকগোষ্ঠী দ্বারা শাসিত এক জাতি। সে কারণে বাঙালি সংস্কৃতিতেও বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতির ধারা এসে মিশেছে। এই ধারাবাহিকতায় বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউরোপিয়ান সংস্কৃতি, যুক্ত হয়েছে মুঘল, পাঠান, আর্য ও অনার্যদের সংস্কৃতি। ভিনদেশি শাসকবর্গের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতি মিশ্রণের ফলে বাঙালি সংস্কৃতিতে অভিনব এক পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। সে কারণেই বাঙালি সংস্কৃতির চেহারায় বিভিন্ন জাতির আচার, খাদ্য, সংগীত, ধর্মীয় বিশ্বাস ও মননের ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এখন বাংলা সংস্কৃতির বিকাশের পথ নানাভাবে থমকে দাঁড়াচ্ছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশ থেকে এখন যাত্রা, পালাগান, কবিগান, কীর্তন প্রাসাদী একরকম হারিয়ে যেতে বসেছে। আমাদের দেশের ঐতিহ্য বাউলদের এখন ত্রাহি দশা! বাউলদের লম্বা চুল জোর করে কেটে ফেলা হচ্ছে। এমন খবরও আমাদের পত্রিকার পাতায় পড়তে হচ্ছে। কিন্তু এই কি বাংলার সংস্কৃতি? এই সংস্কৃতির সঙ্গেই কি বাঙালির পরিচয় ঘটেছিল?
যদি বলি বর্তমান সময়ে আমাদের চিরায়ত বাংলা সংস্কৃতি নানাভাবে হুমকির সামনে পড়েছে, তাহলে সে কথা মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না। একদিকে যেমন বাংলাদেশে ধর্মীয় উন্মাদনা বেড়েছে, অপরদিকে একটি নির্দিষ্ট চিহ্নিত গোষ্ঠী বাংলা সংস্কৃতির হাজার বছরের শেকড় উপড়ে ফেলতে ওত পেতে বসে আছে। এই কদিন আগে বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম অংশ ‘টিপ’ নিয়ে কত ঘটনাই না ঘটে গেল! বাঙালি মুসলমান নারীদের জন্য নাকি টিপ পরা হারাম! এখন ভয় হয় টিপের মতো একদিন ‘পয়লা বৈশাখ’ও হয়তো নিষিদ্ধ করার জন্যও জিগির উঠবে। কিন্তু এই অশুভ শক্তির হাত থেকে আমাদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হলে আমাদেরকেই সচেতন হতে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্মের আত্মায় সেই শেকড়কে আরও বেশি শক্তিশালী করে গেঁথে দিতে হবে। সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকেও নানা রকম উৎসাহব্যঞ্জক উদ্যোগ হাতে নিতে হবে। ভেবে দেখুন, আমাদের সেই ছেলেবেলায় দেখা পয়লা বৈশাখ আর বর্তমান সময়ের পয়লা বৈশাখের মধ্যে কতই না পার্থক্য! এখন যুগ পাল্টেছে, মানুষের মনে এখন ডিজিটাল হাওয়া বইছে। কিন্তু সত্যি করে বুকে হাত রেখে বলুন তো, আমরা কি আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতিটাকে ফিরিয়ে পেতে এখনো আকুতি-মিনতি করি না! এখনো সেই পুরোনো সুন্দর সময়টাকে আঁকড়ে ধরতে কার না মন চায়? পুরোনো গান, পুরোনো নাটক, যাত্রাপালা, রমিজ পাগলার কবিগান শুনলে মনটা নস্টালজিক হয়ে পড়ে না?
মনে আছে, আমাদের গ্রামের বাড়িতে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে একটা বটগাছের নিচে প্রতিবছর পয়লা বৈশাখের মেলা বসত। আমরা ছেলেবেলায় সেই মেলাকে বলতাম ‘বান্নি’। আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে এই মেলাটি ছিল পায়ে হাঁটার পথ। বৈশাখের সোনালি রোদ গায়ে মেখে আব্বা হাঁটছেন ফিনফিনে ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে আর আমরা ছেলেমেয়েরা লাফাচ্ছি আব্বার দু’পাশে চক্কর খেতে খেতে। মেলায় আমাদের দু’দফা যাওয়া হতো। প্রথম যেতাম খুব সকালে নতুন গুড়ের জিলাপি আর বিন্নি ধানের খই কিনতে। সেই সাতসকালে মেলা হয়তো ঠিকমতো জমে ওঠেনি কিন্তু চলে যেতাম গরম গরম জিলাপি আর খই কিনতে। সেসব দিয়েই আমাদের বৈশাখের নাশতা পর্ব শেষ হতো। দ্বিতীয় দফায় যাওয়া হতো বিকেলবেলায়। তখন দূর থেকেই মেলার জনতার ‘গুমগুম’ আওয়াজ শুনতে পেতাম। সে এক ভয়ংকর শব্দ! সৈয়দ হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ এর সেই শব্দ! ‘মানুষ আসতি আছে যমুনার বানের লাহান!’
মেলা থেকে আমি কিনতাম বিশাল সাইজের ঢাউস ঘুড়ি। স্থানীয় ভাষায় সেই ঘুড়িকে বলত ‘ডাউস গুড্ডি’। আকাশে অনেক উঁচুতে যে ঘুড়িটা উড়ত, সেই ঘুড়িটাই আব্বা আমাকে কিনে দিতেন। আব্বা ঘুড়িওয়ালাকে বলতেন, ‘এই গুড্ডিডা আসমান থাইকা নামাও।’ ‘জি স্যার’ বলে সাত আসমানের উপর থেকে গুড্ডিটা ধীরে ধীরে নেমে আমার কোলে এসে বসত! আর তখন আনন্দ দেখে কে? শুধুই কি ঘুড়ি? সুতা কিনতে হবে না? ঘুড়ির দোকানের পাশেই ছিল সুতার দোকান। ‘সুতাপট্টি!’ সেখান থেকে সুতাও কেনা হতো। যত বেশি সুতা কেনা যায়, ঘুড়িটা ততই আকাশের উঁচুতে উঠবে। না, কেনাকাটা এখনো শেষ হয় নাই। মাছের পিঠের মতো দেখতে চকচকে রুপালি রঙের ধারালো চাকু কিনতে হবে না?। চাকুটা ভাঁজ করে কায়দা করে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখাটা একধরনের ‘ব্যাপার’ ছিল। আর এই চাকু দিয়ে বৈশাখে জন্ম নেওয়া নতুন তরতাজা কচি আম কেটে না খেতে পারলে তো জীবনটাই বৃথা! তারপর একটা বাঁশি, লাল-নীল নকশাকাটা হাতপাখা, বাঘের মুখোশ, খেজুরের গুড়ের সন্দেশ আর চিনি দিয়ে বানানো হাতিম ঘোড়া, নৌকা ইত্যাদি। আমরা বলতাম ‘খেলনা’...এই তো! তারপর হঠাৎ কী মনে করে যেন আব্বাই বলতেন, ‘কিরে, বায়োস্কোপ দেখবি?’ ‘বায়োস্কোপ?’ একসঙ্গে আমাদের সবার চিৎকার! মেলার মাঠের এক পাশে এক ঝাঁকড়া চুলো হাতে ডুগডুগি নিয়ে গান ধরেছে।
‘রাজা আইলো ঘোড়ায় চইড়া
তরোয়াল নিয়া
মজার মজার খেলা দেখ
হইবে তাহার বিয়া।’
ছোট পালকির মতো একটা ঘর আর সেই ঘরের দু’পাশ থেকে তিনটি কি চারটি করে কাচের গোল গোল জানালা। আমরা তখন বায়োস্কোপের গোল জানালায় মাথা ঢুকিয়ে দেখছি লাল নীল হলুদ কমলা রঙের জাদুকরি শৈশব! বায়োস্কোপ পর্ব শেষ হলে দু’হাত বোঝাই সাধের সওদা কাঁধে নিয়ে, বাঁশের বাঁশিটাকে এলোপাতাড়ি জোরে বাজাতে বাজাতে আমি আর আমার বোন আবার সেই গোধূলির ধুলো উড়িয়ে বাড়িমুখী হতাম। দূর থেকেই দেখতে পেতাম, আমাদের ছোট্ট ঘরটার জানালার পর্দার আড়ালে আম্মার হাসিমাখা মুখ। মায়ের সেই মুখ দেখে আমাদের আহ্লাদের পরিমাণ যে আরও দশগুণ বেড়ে যেত, সে কথা না হয় আর না-ইবা বললাম!
বাংলা সংস্কৃতি বেঁচে থাকুক আমাদের আত্মায়, আমাদের মননে। যুগ যুগ ধরে হাজার বছরের গর্বিত এই বাংলা সংস্কৃতির ধারা আমাদের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হোক, হতেই থাকুক। সবার জন্য এই নতুন বাংলা বছর মঙ্গল বয়ে আনুক।