Thikana News
০৫ জুলাই ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

অ্যা ট্রিবিউট টু জুলাই রেভল্যুশন

অ্যা ট্রিবিউট টু জুলাই রেভল্যুশন
বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন কোনো সামরিক ক্যু বা দলীয় কোন্দলের জেরে ঘটেনি, বরং তা ঘটেছে তার দীর্ঘ দেড় দশকের স্বৈরশাসনে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে জমে থাকা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে। এই ক্ষোভের সৃষ্টি হয় তার ও তার সরকারের সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন, দুর্নীতি, কমবেশি সব গণতান্ত্রিক অধিকার হরণসহ আরও অনেক কারণে; যেগুলো নিয়ে এখানে সবিস্তারে আলোচনার অবকাশ আছে বলে মনে করি না। তবে মোটাদাগে প্রধানত যে কারণে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আপামর জনগণ ক্ষোভে ফুঁসে উঠে তার পতনের লক্ষ্যে রাজপথে নেমে আসে, তা হলো প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তির নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন, জেলে প্রেরণ, বিচারবহির্ভূত গুম-হত্যা ইত্যাদি, যেটা জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। নির্যাতন-নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনায় জুলুম-নির্যাতনের ব্যাপকতা সম্পর্কে আঁচ করা যায়।

এ প্রসঙ্গে আমার পরিচিত উপজেলা পর্যায়ে সভাপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন বিএনপি নেতার বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। অত্যন্ত দুঃখ ও ক্ষোভের সঙ্গে তিনি আমাকে জানান, শেখ হাসিনার দমন-পীড়ন ও গ্রেপ্তারের ভয়ে তিনি গত দেড় দশকে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে ব্যর্থ হন, যে কারণে তার এলাকায় দলীয় কার্যক্রম একরকম স্থবির হয়ে পড়ে। কেন্দ্র থেকে দলের ঘোষিত বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে তিনি ও দলের বহু নেতাকর্মী সর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত থেকেছেন। কেন্দ্র থেকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অনেকে জেল-জুলুম ও গ্রেপ্তারের ভয়ে রীতিমতো ঘরছাড়া হয়ে পালিয়ে বেড়ান। বিরোধী পক্ষের অনেক শীর্ষ নেতা, যেমন মির্জা ফখরুল, মির্জা আব্বাস, খন্দকার মোশাররফ, গয়েশ্বর রায়সহ বহু নেতাকে পুলিশ গভীর রাতে বাড়িতে হানা দিয়ে ধরে নিয়ে জেলে প্রেরণ করে। আন্দোলন কর্মসূচিতে দলের নেতাদের অংশগ্রহণ ঠেকাতে আগেভাগে (চৎব-বসঢ়ঃরাব) বহু নেতাকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়। তথ্যমতে, বিরোধী পক্ষের বহু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, জঙ্গি ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে লক্ষাধিক মামলা দিয়ে অর্ধলাখের বেশি নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়। গুম-খুনের শিকার হন কয়েক শ নেতাকর্মী। বিরোধী পক্ষের আন্দোলন ঠেকাতে পুলিশকে মৌখিকভাবে ইনডেমনিটি দিয়ে তাদেরকে অত্যাচার-নির্যাতনের লাইসেন্স দেওয়া হয়।

দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষ যেমন কোনো কিছুর পরোয়া করে না, শেখ হাসিনা সরকারের অত্যাচারের স্টিমরোলারে অতিষ্ঠ বাংলাদেশের মানুষ ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে কোটা আন্দোলনকালে সংঘটিত ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও পূর্ব থেকে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে, বিশেষ করে তরুণ শিক্ষার্থী সমাজ সরকারের পতন ঘটাতে মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে দলে দলে রাজপথে নেমে এক অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক বিপ্লবের সূচনা করে। কোটা সংস্কারের আট দফা দাবি সরকার পদত্যাগের এক দফায় নেমে আসে। ‘এক দফা এক দাবি, শেখ হাসিনা তুই কবে যাবি’ হয়ে ওঠে সব মানুষের মুখে সমস্বরে উচ্চারিত এক স্লোগান।

স্ফুলিঙ্গ থেকে ছাত্র-জনতার বিপ্লব দাবানলে পরিণত হয়ে তা প্রবল বেগে ক্ষমতার দুর্গ গণভবনের (ফরাসি বিপ্লবের বাস্তিল দুর্গের মতো) দিকে ধেয়ে আসতে থাকলে ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক প্রাণভয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়।
সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ, প্রশাসনসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের সব প্রতিষ্ঠানের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ থাকায় আন্দোলনের মাধ্যমে লৌহমানবীর তকমাপ্রাপ্ত শেখ হাসিনার পতন অনেকের কাছে অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল। সেই বদ্ধমূল ধারণা ছাত্র-জনতার সম্মিলিত শক্তির মুখে ভেঙে খান খান হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে আপামর জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো কিছুর পরিবর্তন চাইলে জনগণের সেই আকাক্সক্ষাকে কোনোভাবেই দমিয়ে রাখা যায় না। অতীতে সংঘটিত সব বিপ্লব (ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকান বিপ্লব ইত্যাদি) সেই সাক্ষ্যই দেয়।

নিজেদের জগতে আত্মমগ্ন রাজনীতিবিমুখ শিক্ষার্থী ও জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যেভাবে প্রাণের ভয় উপেক্ষা করে স্বৈরশাসনের জাঁতাকল থেকে বেরিয়ে আসার সংকল্প নিয়ে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো রাজপথে নেমে আসে, তাকে এককথায় অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক বলা যায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হয় জনমুক্তির দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলি তৎকালীন রাষ্ট্রযন্ত্রের এক মর্মবিদারক গণহত্যার ইতিহাস। শেখ হাসিনার পতনের এক বছর পেরিয়ে গেলেও জনমানুষের বিরুদ্ধে তার নির্মমতার ভয়াবহ নমুনা (আয়নাঘর, টর্চার সেল ইত্যাদি) এখনো প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হতে দেখা যায়।
জুলাই বিপ্লবে মীর মুগ্ধের ‘পানি লাগবে পানি’, আবু সাঈদের দু’হাত তুলে নির্ভয়ে বুক চিতিয়ে পুলিশের বন্দুকের সামনে দাঁড়ানো, স্কুলের ছাত্রীদের ইউনিফর্ম পরে মিছিলে যোগ দিয়ে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের দৃশ্যাবলি আমার মতো বহু মানুষের মনে যে রকম গভীরভাবে রেখাপাত করেছে, সেটা কখনোই মুছে যাওয়ার নয়। প্রসঙ্গক্রমে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন মনে পড়ছে : আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়/ পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,/ এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়/ আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা। জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থীরা কবি সুকান্তের কবিতার প্রাসঙ্গিকতা নতুন করে প্রমাণ করে দিয়েছে।

ফরাসি বিপ্লবে বাস্তিল দুর্গের পতনের দিন ১৪ জুলাই যেমন ফ্রান্সের জাতীয় দিবস, জাতীয় ঐক্যের সূত্রে স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির স্মারক ৫ আগস্ট হোক বাংলাদেশের জাতীয় দিবস। জুলাই বিপ্লবের সব যোদ্ধার জন্য রইল সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
লেখক : কলামিস্ট
 

কমেন্ট বক্স